মান নিয়ে প্রশ্ন সর্বস্তরে

চৈত্র সেলের ধাঁচেই গ্রেস ডাক্তারিতে

এ বছরের ছাত্রছাত্রীরা উতরে না-গেলে পরের বছরের জন্য জায়গা কমে যাবে। তাই পড়ুয়াদের মেধা যা-ই হোক না কেন, তাঁদের উতরে দিতে ঢালাও গ্রেস মার্কস দেওয়া শুরু হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭ ০৩:২৬
Share:

অনেকে বলছেন, এ যেন চৈত্র সেল! নতুন বছর আসছে। তাই দোকান খালি করে নতুন জিনিস ভরতে হবে।

Advertisement

এখানে ‘দোকান’ অবশ্য রাজ্যের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলি। আর ‘জামাকাপড়’ সেখানকার পড়ুয়াদের একাংশ। এ বছরের ছাত্রছাত্রীরা উতরে না-গেলে পরের বছরের জন্য জায়গা কমে যাবে। তাই পড়ুয়াদের মেধা যা-ই হোক না কেন, তাঁদের উতরে দিতে ঢালাও গ্রেস মার্কস দেওয়া শুরু হয়েছে রাজ্যের বিভিন্ন বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে। ডাক্তারির পঠনপাঠনের ঠিকঠাক পরিকাঠামোই যেখানে গড়ে ওঠেনি, সেখানকার অধিকাংশ পড়ুয়া কী ভাবে পাশ করে যাচ্ছেন, তা খতিয়ে দেখতে গিয়ে বিষয়টি নজরে এসেছে স্বাস্থ্য দফতরের কর্তাদের।

স্বাস্থ্য-শিক্ষা বিভাগের পরিসংখ্যান, তিন বছর ধরে এ রাজ্যে ডাক্তারিতে পাশের হার বাড়ছে। গ্রেস নিয়ে পাশ করছেন প্রায় ২০ শতাংশ পড়ুয়া, সর্বভারতীয় হিসেব অনুযায়ী যেটা যথেষ্ট বেশি। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার কান্তাপ্রসাদ সিংহও মনে করেন, মেডিক্যাল শিক্ষার স্বার্থে গ্রেস ব্যবস্থাটা উঠে যাওয়াই ভাল। তিনি বলেন, ‘‘আমরা দিন কয়েকের মধ্যেই বৈঠক করব। গ্রেস তুলে দেওয়াটা জরুরি।’’

Advertisement

আরও পড়ুন: বৃহন্নলা নানির স্নেহে বাড়ছে নাগমা-রাহুল

সম্প্রতি দেখা গিয়েছে, কলকাতার একটি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ১০০ শতাংশ পড়ুয়া পাশ করেছেন। জেলার একটি মেডিক্যাল কলেজেও তা-ই। অথচ দু’টি ক্ষেত্রেই পঠনপাঠনের মান নিয়ে অভিযোগ ভূরি ভূরি। খুব একটা পিছিয়ে নেই সরকারি মেডিক্যাল কলেজও। রাজ্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘জেলার একটি মেডিক্যাল কলেজে পরিকাঠামো খুব খারাপ। সেখানেও শতকরা ১০০ জন পাশ করে গিয়েছেন। সৌজন্য গ্রেস! সেখানে স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার প্রভাব কাজ করেছে।’’

সমস্যা তৈরি হয়েছে অন্য দিক থেকেও। এখন গ্রেস নম্বর প্রযোজ্য শুধু এমবিবিএসেই। হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক বা ইউনানির ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা নেই। তাই চিকিৎসাবিদ্যার ওই সব শাখার ছাত্রছাত্রীরাও স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে চাপ দিতে শুরু করেছেন। তাই শাঁখের করাতের অবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের।

মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)-র নিয়ম অনুযায়ী মেডিক্যাল পড়ুয়াদের প্রতি বছরে যে-কোনও একটা পেপারে পাঁচ নম্বর পর্যন্ত গ্রেস দেওয়া যায়। পাঁচের বেশি কোনও ভাবেই নয়। এমসিআইয়ের এই নিয়ম কোনও রাজ্য মানতেও পারে, না-ও মানতে পারে।

আরও পড়ুন:

এ রাজ্যে সাধারণ ভাবে মেডিক্যালে গ্রেস নম্বর দেওয়া হতো না। স্বাস্থ্য ভবনের খবর, ২০১৪ সালে পাশের হার এক ধাক্কায় আচমকা অনেকটাই কমে যাওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে চাপ
আসছিল। তার পরেই ঢালাও গ্রেস দেওয়া শুরু হয়। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে।

স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্তা অবশ্য বলেন, ‘‘বেশি দিন এই বোঝা বইতে হবে না। মেডিক্যালে ভর্তির ক্ষেত্রে অভিন্ন প্রবেশিকা পরীক্ষা (নিট) চালু হয়ে গিয়েছে। ডাক্তারি পড়ুয়াদের ন্যূনতম যোগ্যতা নিয়ে সংশয় এখন কেটেছে।’’ স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, মেডিক্যালে ভর্তি নিয়ে দেদার টাকার খেলা চলে। নিট চালু হওয়ায় সেটা আর ওই হারে সম্ভব হবে না। ‘‘তাই আগের পড়ুয়াদের সকলকে যে-ভাবেই হোক, পাশ করিয়ে দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন অনেকেই। এটা বন্ধ করার জন্য স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কেই কঠোর হতে হবে,’’ বলছেন স্বাস্থ্য বিভাগের ওই কর্তা।

কিন্তু স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়-কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, গ্রেস তুলে দিলে বড় ধরনের আন্দোলনের সম্মুখীন হতে হবে তাঁদের। যদিও দলমত নির্বিশেষে জুনিয়র ডাক্তারেরা জানিয়েছেন, তাঁরাও চান, গ্রেস ব্যবস্থা উঠে যাক। তৃণমূলের সংগঠনের তরফে রৌনক হাজারি বা ডিএসও-র কবিউল হক একবাক্যে জানান, গ্রেস ব্যবস্থা বহাল রেখে চিকিৎসার মানের সঙ্গে বড় ধরনের আপস করা হচ্ছে। এটা না-উঠলে মানুষ ভবিষ্যতে ভরসা করে তরুণ ডাক্তারদের কাছে যেতে পারবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন