নির্দল প্রার্থীকে পাশে নিয়ে শিলিগুড়ি পুরবোর্ড গড়ার মুখে দলের অন্দরেই ধাক্কা খেলেন অশোক ভট্টাচার্য। দল সূত্রের খবর, পুরসভার ডেপুটি মেয়র, চেয়ারপার্সন এবং গুরুত্বপূর্ণ মেয়র পারিষদ কে হবেন, তা নিয়েই দলের অন্দরে নানা বিতর্ক, ক্ষোভ দানা বাঁধছে। এমনকী, কয়েক জন প্রবীণ কাউন্সিলর প্রত্যাশিত পদ না পেলে প্রয়োজনে ইস্তফা দিয়ে ফের ভোট করানোর পথেও হাঁটার কথা ভাবছেন বলে ঘনিষ্ঠদের জানিয়ে দিয়েছেন। বৃহস্পতিবার শিলিগুড়িতে সিপিএম ও তার শরিক দলের কাউন্সিলরদের বৈঠকের পরে এমন আশঙ্কার কথাই শোনা গিয়েছে। ঘটনাচক্রে, ওই পরিস্থিতির দিকে নজর রাখছে তৃণমূলও। দলীয় সূত্রেই খবর, যে সব বাম কাউন্সিলর দীর্ঘদিন ধরে জিতছেন, তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছেন। ফলে, বোর্ড গড়ার মুখেই উদ্বেগ বাড়ছে বাম শিবিরে।
যদিও বামেদের মেয়র পদের দাবিদার অশোকবাবু বলেছেন, ‘‘কেন এমন রটছে জানি না। আমরা বোর্ড গঠনের বিজ্ঞপ্তি জারি হলে প্রথমে মেয়র ও চেয়ারম্যান পদের জন্য মনোনয়ন পেশ করব। ডেপুটি মেয়র, মেয়র পারিষদ কারা হবেন, তা ঠিক হবে বোর্ড গঠনের পরে। এটা নিয়ে কোনও আলোচনা দলের বৈঠকে হয়নি। তবে রাজ্য বামফ্রন্টের রীতি মেনে শরিক দলের কেউ জিতলে তাঁদেরই ডেপুটি পদ দেওয়ার কথা।’’
শিলিগুড়িতে বাম শরিক আরএসপি ও ফরওয়ার্ড ব্লক একটি করে আসন পেয়েছে। বয়সে ও অভিজ্ঞতায় প্রবীণ হওয়ায় আরএসপি-র একাধিকবারের কাউন্সিলর রামভজন মাহাতোই ডেপুটি পদের দাবিদার। কিন্তু বাম সূত্রের খবর, তিনি নাকি ওই পদে বসতে এখনও রাজি হননি। অন্য দিকে আবার এক জন একাধিকবার জয়ী সিপিএম কাউন্সিলর তথা জেলা পর্যায়ের নেতাকে চেয়ারম্যান পদে বসানোর প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি রাজি হননি। বরং, তিনি ডেপুটি মেয়র পদে বেশি আগ্রহী।
দলের অন্দরের খবর, সিপিএমের ওই প্রবীণ নেতাকে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে সামনে রেখে লড়লে দল বিপাকে পড়তে পারে— এমন আশঙ্কা থেকেই খোদ অশোকবাবু নেতৃত্ব দিতে আসরে নামতে বাধ্য হয়েছিলেন। যে সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে নানা সময়ে উদ্ধত আচরণের অভিযোগ উঠেছে, তাঁকেই যদি এখন অশোকবাবু ডেপুটি মেয়র পদে বসান তা হলে দলে তো বটেই, জনমানসেও নানা বিতর্ক দানা বাঁধতে পারে বলে দলের একাংশের আশঙ্কা। এমনকী, দলের কয়েক জন কাউন্সিলরও ঘনিষ্ঠদের মারফতে দলকে জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা তেমন হলে ইস্তফা দিয়ে নতুন করে ‘নির্দল’ হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা ভাবতে বাধ্য হবেন। বামেদের এক জন অবাঙালি কাউন্সিলর ঘনিষ্ঠ মহলে জানিয়ে দিয়েছেন, প্রাপ্য মর্যাদা না পেলে তিনিও ‘অন্যরকম’ ভাবতে বাধ্য হবেন।
এই অবস্থায়, তৃণমূল শিবির বাড়তি মনোবল নিয়ে বোর্ড গড়ার ব্যাপারে আসরে নেমেছে। তৃণমূল সূত্রেই জানা গিয়েছে, তাদের মেয়র পদ প্রত্যাশী নান্টু পাল কলকাতা থেকে ফিরে ‘কোমর বেঁধে’ প্রয়োজনীয় সাত জনের সমর্থন আদায়ের জন্য আসরে নেমেছেন। দীর্ঘদিন সিপিএম কাউন্সিলর ছিলেন নান্টুবাবু। সিপিএমের অন্দরে অশোকবাবু ও তাঁকে টেক্কা দিতে কে বা কারা দলের মধ্যে চেষ্টা করেন, সেই ব্যাপারে তিনি ওয়াকিবহাল। সিপিএমের অন্দরে ‘অবহেলিত’ বলে কোন কাউন্সিলরের ক্ষোভ রয়েছে, সেটাও জানেন নান্টুবাবু। তিনি যে সেই সুযোগ কাজে লাগাতে মাঠে নেমে পড়েছেন, সেটা সকলেই টের
পাচ্ছেন। নান্টুবাবু বলেন, ‘‘শিলিগুড়িতে উন্নয়ন তৃণমূলের হাত ধরেই হচ্ছে ও হবে। কারণ, তৃণমূল সকলকে প্রাপ্য মর্যাদা দেয়।’’ উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবও এর আগে বোর্ড গড়ার ব্যাপারে নিজেদের প্রচেষ্টা সম্পর্কে কিছু বলতে চাননি। তিনিও সিপিএমের অন্দরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ কাজে লাগাতে এখন তৎপর। গৌতমবাবুর তরফেও নানা বাম কাউন্সিলরের ব্যাপারে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। যদিও গৌতমবাবু কেবল বলেন, ‘‘সময় হলে সবই বলব।’’
৪৭ আসনের পুরসভায় ২৩টি আসন ও নির্দল অরবিন্দ ঘোষের সমর্থন প্রায় মিলেই গিয়েছে। ফলে, সব ঠিকঠাক চললে মেয়র হওয়া প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর কাছে সময়ের অপেক্ষা। কিন্তু, ঘরের মধ্যে যে বিবাদ শুরু হয়েছে তা
সামাল দিতে না পারলে যে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা পুরোপুরি জলে যেতে পারে সেটাও মানছেন বামেদের অনেকেই। তবে প্রাক্তন পুরমন্ত্রীর দাবি, ‘‘ঘটনার চেয়ে রটনা বেশি। আমাদের দলের সবাই এককাট্টা। আমরাই বোর্ড গড়ব।’’
বোর্ড গড়া নিশ্চিত হলেও নানা পদ প্রত্যাশীদের সন্তুষ্ট করতে না পারলে আগামী দিনে ধাক্কাটা আরও কত জোরদার হবে সেটা অবশ্য এখনই বলা যাবে না।