হাতের ভরসায় চলল কিছু, হাওড়ায় রেল চলাচল জলেই

যেন সাত হাজার ফুট উঁচুতে গাঢ় কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়ি জনপদ ঘুম থেকে স্রেফ হাতের আন্দাজে গাড়ি চালিয়ে শিলিগুড়ির দিকে নামা!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:২৩
Share:

জলযাত্রা। মঙ্গলবার টিকিয়াপাড়া রেল ইয়ার্ডে দীপঙ্কর মজুমদারের তোলা ছবি।

যেন সাত হাজার ফুট উঁচুতে গাঢ় কুয়াশায় ঘেরা পাহাড়ি জনপদ ঘুম থেকে স্রেফ হাতের আন্দাজে গাড়ি চালিয়ে শিলিগুড়ির দিকে নামা!

Advertisement

গত সোমবার দুপুর থেকে নিম্নচাপের বৃষ্টির ঠেলায় রেলের সব প্রযুক্তিই কার্যত উধাও হয়ে গিয়েছিল। কারশেডে রেল লাইনের আঁকিবুকি, পয়েন্ট— সবই জলের তলায়। ফলে অকেজো হয়ে গিয়েছিল রুট রিলে ইন্টারলক (আরআরআই) কেবিনও। ওই অবস্থায় ট্রেন চালু রাখাটাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষের কাছে। আর সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভরসা ছিল হাতের আন্দাজ। তাই দিয়েই কোনও মতে কিছু ট্রেন চালিয়ে ঘরমুখো নিত্যযাত্রীদের গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন রেলকর্মীরা।

এমনিতে ট্রেন চলাচল ব্যবস্থাটা কেমন? রেলকর্তারা জানান, ট্রেন নিয়ন্ত্রিত হয় আরআরআই কেবিন থেকে। সেখানে থাকে ডিজিটাল লাইট বোর্ড। কয়েক কিলোমিটার দূরে কী ভাবে তারের জালের মতো লাইন গিয়েছে, কোথায় পয়েন্ট, কোথায় সিগন্যাল— ওই ডিজিটাল বোর্ড আসলে তারই বিশদ ম্যাপ। যে লাইন দিয়ে যখন ট্রেন চলে, তখন তার যাত্রাপথ ফুটে ওঠে ডিজিটাল বোর্ডে। কোথায় সবুজ সিগন্যাল, কোথায় লাল, স্টেশন কর্তাদের চোখের সামনে সবই ফুটে ওঠে ওই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার মাধ্যমে। সেখানে বসেই তাঁরা ট্রেনের গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করেন।

Advertisement

লাইন ডুবে যাওয়ায় সোমবার রাতে ডিজিটাল বোর্ডের সব আলোই লাল হয়ে যায়! তাই কোন লাইন দিয়ে ট্রেন চালানো হবে, কেবিনে বসে সেটা ঠাহর করতে পারা কঠিন হয়ে পড়ে। কারশেডে লাইনে লোক নামিয়ে হাত দিয়ে ‘ক্রসিং পয়েন্ট সেট’ করে কয়েকটি লাইন দিয়ে কিছু স্পেশাল ট্রেন চালানোর ব্যবস্থা করা হয়।

কিন্তু ওইটুকুই! হাওড়ায় বাকি রেল পরিষেবা কার্যত জলে গিয়েছে কারশেডে জল জমায়। রেলের খবর, মঙ্গলবার দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ৩৯টি লোকাল, সাতটি মেল-এক্সপ্রেস ও চারটি প্যাসেঞ্জার ট্রেন বাতিল হয়। পূর্ব রেলের চারটি মেল-এক্সপ্রেস ছাড়ার সময় বদলানো হয়েছে। লোকাল ট্রেন গড়ে ৩০ মিনিট দেরিতে চলেছে। আজ, বুধবার রূপসী বাংলা, তাম্রলিপ্ত, বরবিল জনশতাব্দী, ইস্পাত এক্সপ্রেস বাতিল হয়েছে।

কিন্তু কারশেড থেকে জমা জল বের করা গেল না কেন? রেল সূত্রের খবর, সোমবার রাতভর পাম্প চলেছে। মঙ্গলবারও ভোর থেকে পাম্প চালিয়ে কারশেড থেকে জল বের করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু সেই জল বিকেল পর্যন্ত নামানো যায়নি। রেলকর্তারা জানান, পাম্প করে যে জল বের করা হচ্ছে, তা কিছুক্ষণের মধ্যেই আশপাশের নালা দিয়ে ফিরে এসেছে! হুগলি নদীর জলস্তর বেশি থাকায় নিকাশি নালা দিয়ে কিছুতেই জল বের করা যায়নি।

টিকিয়াপাড়া কারশেড এলাকায় জমা জলের জন্য ট্রেন চলাচলও স্বাভাবিক করা যায়নি।

যাত্রীদের প্রশ্ন, বৃষ্টি হলেই কেন বার বার ভেসে যায় হাওড়া স্টেশন এলাকা? রেলকর্তাদের কেউ কেউ বলছেন, হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন ওই এলাকার আকার অনেকটা কড়াইয়ের মতো। তাই জল জমার প্রবণতা। আর সেই কারণেই প্রযুক্তি এবং কারিগরি ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

তা হলে দরকারের সময়ে সেই ব্যবস্থা বিকল হল কেন? রেলকর্তাদের অভিযোগ, হাওড়া পুরসভা নিকাশি সাফাইয়ের কাজে মোটেই তৎপর নয়। সংলগ্ন রানি ঝিলও তারা সংস্কার করেনি। তাতেই যাত্রীদের এত দুর্ভোগ। হাওড়া পুরসভার মেয়র রথীন চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, ‘‘রেল লাইন পাতার সময় ঠিক মতো নিকাশির ব্যবস্থা করা হয়নি।’’ ঝিল সংস্কারও রেলের কাজ বলে দাবি করেন তিনি।

হাওড়া স্টেশনের পুরনো ভবন থেকে পূর্ব রেলের ব্যান্ডেল ও বর্ধমানমুখী ট্রেন চলে। আর নতুন ভবন থেকে চালানো হয় দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাওড়া-খড়্গপুর শাখার ট্রেন। কিন্তু সব ট্রেনই স্টেশন থেকে ছাড়ার পরে কিছুটা এলাকা একই লাইন দিয়ে যায়। কারশেড লাগোয়া প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকা জলের তলায় চলে যাওয়ায় সব রুটের যাত্রীরাই দুর্ভোগে পড়েন।

মঙ্গলবার বেলা ১০টা নাগাদ টিকিয়াপাড়া কারশেডের সামনে গিয়ে দেখা গেল, তখনও জল থইথই। রেল লাইনের প্রায় দেড় ফুট উপরে জল। সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে লোকাল ও দূরপাল্লার ট্রেন। পাঁশকুড়ার বাসিন্দা সেখ আনিরুল ইসলাম বলেন, ‘‘এমন অবস্থা কখনও দেখিনি। সাঁতরাগাছি থেকে লাইন দিয়ে ট্রেন দাঁড়িয়ে। তাই বাধ্য হয়ে নেমে পড়েছি।’’

হাওড়া মেন লাইনের বাসিন্দা তথা সরকারি দফতরের কর্তা সমর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘লিলুয়ায় এসে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে শেষমেশ লাইন ধরেই হাঁটছি! কী করব, যেতে তো হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন