উৎসবের রঙে কলোনিতে শাপমুক্তির আলো

বসিরহাট পুরএলাকায় গোয়ালপোতার ‘বার্মা কলোনি’। পোশাকি নাম, চট্টল মনসাপল্লি। বারো আনা লোকই চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। রুটিরুজির টানে একদা বর্মা মুলুকে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া ৩০-৩৫ ঘর মুসলিমের বাস। টালির চাল-প্লাস্টিক ছাওয়া গেরস্ত মহল্লা। মাস্টারদা, নেতাজির জন্মদিনে কুইজ-স্পোর্টস।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ০৩:৫৪
Share:

সপসপে শাড়ি গায়ে ভেজা বকের মতো কাঁপছিল পোয়াতি মেয়েটা। মেছো বিলের বুকজল ঠেলে রাতবিরেতে ঘর ছেড়ে এসেছে। তাকে দেখে কেঁদে একসা মর্জিনা বিবি। তাঁর নিজের ঘরে বৌমার তখন আট মাস চলছে। ভিনধর্মী পরের মেয়েকে বুকে টানতে একফোঁটা ভাবতে হয়নি। হিন্দু-মুসলিমে হাত মিলিয়ে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোটা পাড়াই।

Advertisement

দুর্যোগের সেই রাত ঢের পিছনে। পরীর মতো নাতনির জন্মই উৎসবের আলো জ্বেলেছে মর্জিনার ঘরে। স্বামী আহম্মদ গাজিকে খুঁচিয়ে ও-পাড়ার রোগা মেয়েটার ‘ডেলিভারি’ নির্বিঘ্নে মেটার খবরও জেনেছেন নতুন দাদিমা।

ছেলে বাবন ছোট থাকতে তাকে বসিরহাট ঘুরে ঠাকুর দেখাতে হতো। পুজো এলে সেই ছেলে এখনও বয়স ভুলে যায়! অভিজিৎ, রানা, তন্ময়দের সঙ্গেই রাতদিন ওঠাবসা বাবন গাজির। কলোনির মনসামন্দিরে একচালা দুগ্গাঠাকুরের সামনে পাড়ার পুজো। অষ্টমী পড়লেই পাঞ্জাবি চাপিয়ে ফুলবাবু বাবন। নবমীতে রাতভর ঘুরে ইছামতীর নৌকা ভাড়া করে ফিরবে। ভাসান দেখা চাই! বিজয়ায় সুজয়দা, মৃণালকাকা, প্রদীপকাকা-শিখাপিসিদের বাড়িতে প্রণাম করে মিষ্টিমুখ বাঁধা।

Advertisement

চৌধুরী গিন্নি শিখাদেবীর গলা আবেগে থরথর, ‘‘বাবন, মু্ন্না, নজরুলদের বাবা-জ্যাঠারা আমাদের নিজের ভাই-দাদার থেকে কম নয়!’’

বসিরহাট পুরএলাকায় গোয়ালপোতার ‘বার্মা কলোনি’। পোশাকি নাম, চট্টল মনসাপল্লি। বারো আনা লোকই চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। রুটিরুজির টানে একদা বর্মা মুলুকে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া ৩০-৩৫ ঘর মুসলিমের বাস। টালির চাল-প্লাস্টিক ছাওয়া গেরস্ত মহল্লা। মাস্টারদা, নেতাজির জন্মদিনে কুইজ-স্পোর্টস। মাস দুই আগে সেই সূর্য সেন স্মৃতি সংঘের ক্লাবঘরের সামনেই কাঁপছিলেন পাড়ুইপাড়ার বৌটি। মানুষকে ভয় দেখিয়ে দু’ভাগ করতে তখন বোমা ছোড়া, টায়ার জ্বালানো চলছে কাছেপিঠে। শাড়িসায়া প্যান্টজামা হাতে এক কাপড়ে চলে আসা মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে কিন্তু অকুতোভয় বার্মা কলোনি। যে যেমন পারেন, চাঁদা উঠল অত রাতে। ক্লাবের সামনের মাঠে রান্নার আয়োজন হল। ঝমঝমে বর্ষায় বাবনের বাবা নিষ্ঠাবান নমাজি আহম্মদ সাহেবই মুশকিল আসান! আমার ঘরের নতুন গ্যাস-ওভেনটা দিলে সুবিধে হবে কি? বিয়েশাদির আয়োজনে ক’টা মুসলিম বাড়ির একসঙ্গে কেনা পেল্লায় কড়াইটাও কাজে লাগল। বোমাবারুদের গন্ধ ছাপিয়ে বাতাসে ম-ম খিচুড়ির সৌরভ। মনসাপুজোর ভাণ্ডারায় তো ওখানেই চিরকাল কার্তিক-প্রীতমদের সঙ্গে পরিবেশনে হাত লাগান মুন্না-জাহাঙ্গিররা। অষ্টমীর লুচি-ভোজের আসরে বন্ধু পুষ্পা শীলের গায়ে হেসে গড়িয়ে পড়েন হাসিনা বিবি।

বাবন, কার্তিক, প্রীতম, মু্ন্নারা বলেন, মনসা পুজো-দুগ্‌গা পুজোর দিনেও তো এমনই এক হাঁড়িতে খাইদাই সকলে। সূর্য সেনের ছবিওয়ালা ক্লাবঘর, ছোটদের ইস্কুলবাড়িতে তিন দিন, তিন রাত এক করে শ’আড়াই দুর্গতের সেবা। চেনাজানাদের ফোন করে পাড়ার মুরুব্বিরাই খবর আনলেন, গুজব আতঙ্কেই ঘরছাড়া বেশির ভাগ লোক। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে খাইয়েদাইয়ে ঘরে ফেরানো হয় তাঁদের।

মেঘ কেটে উৎসবের রঙে এ বার শাপমুক্তির আলো। ইদের জামাটায় রং ওঠায়, পুজোতেও নতুন জামা দিয়েছে দিনমজুর বাপ! ক্লাস নাইনের ইমরানের চোখেমুখে বিশ্বজয়ের আনন্দ।

বোধনের আগেই টিউব লাইটে সাজে কলোনির রাস্তা! হাসিনা-পুষ্পা, বাবন-রানারা সেই আলোয় ধুয়ে যায়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন