সখিনাকে ঠাঁই দেওয়ায় পুজো বন্ধ সুভাষের

মাথা নিচু করে ফিরে আসার পথে পুরুতমশাই সুভাষ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘কী বলব বলুন, ঘর-হারা একটা মেয়ে রাস্তায় ফ্যাফ্যা করে ঘুরছে, চোখ সইল না। তাই মুসলিম হলেও দু’টি নাবালক বাচ্চা-সহ তরুণীকে ঘরে ঠাঁই দিয়েছি। আমার কাছে ওটাই যে সব চেয়ে বড় ধর্ম!’’

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

হরিহরপাড়া শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৯ ০৩:৩৪
Share:

সন্তান কোলে সখিনা বিবি। পাশে সুুভাষবাবুর স্ত্রী ইলা। নিজস্ব চিত্র

কিছু দিন হল, গ্রামে বিয়ে-পৈতের অনুষ্ঠানে ব্রাত্য হয়েছেন তিনি। সাত সকালে যজমানি করে সামান্য যে আয়ে টিকিয়ে রেখেছিলেন সংসার, দাঁড়ি পড়ে গিয়েছে তার উপরেও। গৃহলক্ষ্মী থেকে বিপত্তারিণী— পুজো করতে গিয়ে তাঁকে শুনতে হচ্ছে, ‘না, ঠাকুরমশাই, আপনাকে আর আসতে হবে না!’

Advertisement

মাথা নিচু করে ফিরে আসার পথে পুরুতমশাই সুভাষ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘কী বলব বলুন, ঘর-হারা একটা মেয়ে রাস্তায় ফ্যাফ্যা করে ঘুরছে, চোখ সইল না। তাই মুসলিম হলেও দু’টি নাবালক বাচ্চা-সহ তরুণীকে ঘরে ঠাঁই দিয়েছি। আমার কাছে ওটাই যে সব চেয়ে বড় ধর্ম!’’

মুর্শিদাবাদের আটপৌরে গ্রাম চোঁয়া। সেখানে যজমানি করে সংসার চলত সুভাষবাবুর। কিছু দিন আগে ভিন্ন ধর্মের সখিনা বিবিকে আশ্রয় দেওয়ায় অশনি ছায়া পড়েছে তাঁর সংসারে।

Advertisement

জলঙ্গির সখিনাকে প্রায় এক কাপড়ে তাড়িয়ে দিয়েছিল তাঁর স্বামী। দু’টি নাবালক পুত্র-কন্যা নিয়ে রাস্তায় বসে থাকা সেই তরুণীকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন সুভাষবাবুর কন্যা কাকলি। বিবাহ বিচ্ছেদের পরে কাকলিও থাকেন বাপের বাড়িতেই। কাকলি বলছেন, ‘‘আশ্রয়হীন এক মহিলা, তাকে দেখেও চোখ বুজে থাকব? বাবাকে এসে বললাম, ওঁকে আমাদের বাড়িতে একটু জায়গা দাও না। বাবা রাজি হতেই নিয়ে এসেছি। আর তার ফলে, গ্রামে আমাদের প্রায় ধোপা নাপিত বন্ধ হওয়ার জোগাড়।’’

সুভাষবাবুর স্ত্রী ইলাও বলছেন, ‘‘আমরা
তো এর মধ্যে কোনও অন্যায় দেখিনি। দু’টো বাচ্চা ছেলে-মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো একটা মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছি, ধর্ম কি তার চেয়েও বড়!’’

সখিনার পরিবার এখন রায়চৌধুরী বাড়ির অঙ্গ। ছেলে-মেয়ে দু’টিকে ভর্তি করিয়েছেন স্থানীয়
প্রাথমিক স্কুলে। ঘরের পাঁচটা কাজ, কাকলি ও ইলাদেবীর সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েই করেন।

এ বাড়িতে এসেও নিজের ধর্ম নিয়ে কোনও বাধা পাননি সখিনা। তিনি বলছেন, ‘‘এক বারের জন্যও আমার ধর্ম নিয়ে আপত্তি তোলেননি সুভাষবাবু। রোজা রাখতেও বাধা দেননি।’’

তবে চোখ টাটিয়েছে গ্রামের মাতব্বরদের। তাঁদের নিদানেই বন্ধ হয়েছে সুভাষবাবুর যজমানি। চোঁয়া গ্রামের এক মাতব্বরের কথায়, ‘‘ভিন্ন ধর্মের মানুষকে ঘরে রেখে কি যজমানি হয়!’’

গ্রামের অনুশাসনে অবশ্য পিছিয়ে যাচ্ছেন না সুভাষবাবু, বলছেন, ‘‘মেয়ের উপর অত্যাচার হলে কী হয় আমি জানি। তাই সখিনাকে এ বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছি। যত দিন না ওর কোনও ব্যবস্থা হয় এখানেই থাকবে ও।’’

সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার আবহে সুভাষবাবুর এই উদারতার কথা কানে গিয়েছে হরিহরপাড়ার বিডিও পূর্ণেন্দু সান্যালের।
তিনি বলেন, ‘‘অসামান্য সাহস দেখিয়েছেন সুভাষবাবু। আমরা সরকারের পক্ষে ওই পরিবারকে সবরকম সহযোগিতা করব। গ্রামে গিয়ে কথাও বলব, মানুষকে বোঝাব। এটাই তো প্রকৃত ধর্ম।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন