Ananda Puraskar

ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববোধের স্বর

ক্ষুদ্র গণ্ডি ভাঙার শক্তিমত্তা তো দেখিয়েছেন আজকের সম্মানিত লেখকও। মাউসের ক্লিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করেছিলেন প্রথম, তার পর এই বই।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩ ০৮:১২
Share:

পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের হাতে আনন্দ পুরস্কার তুলে দিচ্ছেন উমা দাশগুপ্ত। শনিবার। ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী।

ধ্বস্ত পৃথিবীতে কত দিন পর মাথা তুলল জীবনের এই সবুজ সতেজতা? কচি কলাপাতা বা ধানের শিষের রং নয়, নয় জলপাই বা পান্না-সবুজ। মঞ্চের পিছনে হালকা মেটে সবুজ রঙে পাতার মতো আলপনা। শনিবার সন্ধ্যায় জীবন-তানের এই মঞ্চসজ্জা নিয়েই শুরু হল বহু-প্রতীক্ষিত আনন্দসন্ধ্যা। ‘গীতবিতান তথ্যভাণ্ডার’-এর সংকলক ও সম্পাদক পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকারের হাতে আনন্দ পুরস্কার তুলে দিলেন ইতিহাসবিদ উমা দাশগুপ্ত।

Advertisement

ওই ধ্বস্ত সবুজ পাতার মতোই কোথাও কি মায়া রহিয়া গেল? জাতীয়তাবাদের চাপে বিপর্যস্ত দেশের মানুষের প্রতি মায়া? ‘সব ভেদকে ঢেঁকিতে কুটিয়া একটি পিণ্ডাকার বস্তু গড়িয়া তোলাই জাতীয় উন্নতির চরম পরিচয় নহে।’ শ্রীনিকেতনের ইতিহাস-রচয়িতা, রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ এ দিনের প্রধান অতিথি উমার ভাষণে এল ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথের লেখা। একশো বছরেরও আগে, আজকের সময়টা কোন দূরদৃষ্টিবলে দেখেছিলেন তিনি?

শুধু জাতীয়তাবাদ নয়। হাল আমলের প্রতিবাদহীন, নিস্তরঙ্গ মৌন? সেখানেও রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়িয়ে দিলেন প্রধান অতিথি, ‘স্বরাজ আগে আসবে, স্বদেশের সাধনা তার পরে, এমন কথা সত্যহীন।’

Advertisement

এই স্বরাজ এবং স্বদেশের সাধনায় তাঁকে কখনওই আজকের শান্তিনিকেতনের মতো পাঁচিল তুলতে হয়নি। উমার এ দিনের বক্তৃতায় এল কবির বিদেশি অতিথি, ভায়োলিনবাদক আর্থার গেডিসের কথা। গেডিসের বেহালার ছড়ে নিজের গান শুনেই তো রবীন্দ্রনাথ ১৯২৬ সালে তাঁকে গান অনুবাদের অনুমতি দিয়েছিলেন। ‘গান তৈরির মতো সার্থকতার আনন্দ আমি আর কোনও কিছুতেই পাই না,’ ১৯২৩ সালেই গেডিসকে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবির প্রেরণাতেই রাজা নাটকের ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘কোথা বাইরে দূরে’ ইত্যাদি পাঁচটি গান অনুবাদ করেছিলেন গেডিস, জানালেন ইতিহাসবিদ। রবীন্দ্রগানের ইতিহাস বেয়ে স্বদেশের সাধনা, ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতা সব যেন এই পুরস্কারসন্ধ্যায় এক সুতোয় গেঁথে দিলেন তিনি। এখানেই সারাৎসার।

পুরস্কারের মানপত্রও এই জটিলকুটিল সময়ের কথা বলেছে! ‘কঠিন এক সময়ের স্রোত যে সময়ে মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং বিশ্বাসবোধের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে সদা উদ্যত, সেই পরিস্থিতিতে জাতীয়তাবাদ স্বদেশভাবনা এবং আন্তর্জাতিকতার মতো মানবমুক্তির মন্ত্রকে রবীন্দ্রগানই আরও শক্তির জোগান দিতে সক্ষম’, বলা হয়েছে সেখানে।

ক্ষুদ্র গণ্ডি ভাঙার শক্তিমত্তা তো দেখিয়েছেন আজকের সম্মানিত লেখকও। মাউসের ক্লিকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করেছিলেন প্রথম, তার পর এই বই। ‘গান বিষয়ে বিভিন্ন তথ্যকে কয়েকটি সারণির মধ্যে এমন ভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে যাতে অসংখ্য বই অনুসন্ধান না করেও এক লহমাতেই যে কোনও গান সম্পর্কে নানা খবর পাঠকের গোচরে আসে,’ বলছিলেন পূর্ণেন্দুবাবু। ডিজিটাল যুগ তাঁর সময়ে আসেনি, কিন্তু নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তো বারে বারেই সংযোগ তৈরি করেছেন রবীন্দ্রনাথ। জীবদ্দশাতেই রেকর্ডে বেরোচ্ছে তাঁর গান, প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি ছবিতে কানন দেবী গাইছেন ‘আজি সবার রঙে রঙ মিশাতে হবে’, ১৯৩৬ সালেই অনাদি দস্তিদারের পরিচালনায় কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয় রবীন্দ্রগান। সেই আমলে নতুন গ্রামোফোন রেকর্ড থেকে সিনেমা, রেডিয়ো সব প্রযুক্তিকেই যিনি অক্লেশে স্বীকার করে নিয়েছেন, পাঠক-সুবিধার্থে এ রকম তথ্যভাণ্ডারের সারণিকে তো তিনি অক্লেশে সাধুবাদ জানাতেন।

কী হলে কী হত, সেই বিকল্প ইতিহাসের খোঁজে পুরস্কারসন্ধ্যা থাকে না। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা কি এই ভাবেই গানের ব্যঞ্জনায় ধরে দেন অন্য সুর? শনিবার সন্ধ্যায় উমা দাশগুপ্তের বক্তৃতা যেন মনে পড়িয়ে দিল সুদূর ভিয়েনা শহরে সদ্যপ্রয়াত ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহকে। ১৪ বছর আগে ২০০৯ সালে এ রকমই এক সন্ধ্যায় আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। তিনিও তো এক নিবন্ধে ধরে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের গান কোথায় ছাপিয়ে যায় তাঁরই লেখা কবিতাকে। বলাকার ৬ নং কবিতা ‘তুমি কি কেবলি ছবি’র উদাহরণ দিয়েছিলেন তিনি। সেখানে পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষের তর্কাতর্কিতে অনুভব যেন কোণঠাসা। অথচ ১৭ বছর পর লেখা একই গানে সেই অসমতা অনুপস্থিত। ঘনসংবদ্ধ গানটিতে মূলের মহাজাগতিক ধারণা অক্ষুণ্ণ, অথচ জড়জগতের অর্থসীমা পেরিয়ে ব্যঞ্জনা সফল ভাবেই বিশ্বকে মিলিয়ে দেয় ব্যক্তিসত্তার অন্তরঙ্গ বিশেষে। উমা দাশগুপ্তের এ দিনের বক্তৃতাতেও রবীন্দ্রনাথের সেই বিশ্ববীক্ষার ঝঙ্কার, ‘বিশ্ব এবং বিশ্ববোধ কবিগুরুর আজীবনের প্রয়াস ছিল।’

বিশ্ববীক্ষণের এই সহজ সারণি না থাকলে কে অনায়াসে জানত, রবীন্দ্রগানের ৩১ শতাংশই শান্তিনিকেতনে লেখা। দ্বিতীয় শিলাইদহ, সেখানে লেখা হয়েছে মোট গানের ৬ শতাংশ! বিপর্যাসের এই পৃথিবীতে অনুপুঙ্খ, পরিশ্রমী তথ্যচয়নেই তো মুক্তি, যাবতীয় ক্ষুদ্র পাঁচিল অক্লেশে ভেঙে যায়, তিন বছর পর ধ্বস্ত পৃথিবীর বুকে ফের জন্মায় মেটে সবুজ পাতার আলপনা!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন