নিশানায় সিভিক ভলান্টিয়ার

‘ছেড়ে দে, বুড়োটা মরে যাবে’

যে এলাকার আমি চার বারের বিধায়ক, সেখানেই যে এ ভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে, কখনও ভাবিনি। তা-ও ৭০ বছর বয়সে পৌঁছে! দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক ওঠাপড়া আর রাজনৈতিক গোলমালের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু, শনিবার ময়ূরেশ্বরে যা হল, তা এখনও দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে।

Advertisement

ধীরেন লেট

শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০১৫ ০০:৩৯
Share:

রবিবার সিউড়ি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ধীরেন লেটের ছবিটি তুলেছেন তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

যে এলাকার আমি চার বারের বিধায়ক, সেখানেই যে এ ভাবে লাঞ্ছিত হতে হবে, কখনও ভাবিনি। তা-ও ৭০ বছর বয়সে পৌঁছে! দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক ওঠাপড়া আর রাজনৈতিক গোলমালের মুখোমুখি হয়েছি। কিন্তু, শনিবার ময়ূরেশ্বরে যা হল, তা এখনও দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে। এক দল গুন্ডা আমাকে প্রকাশ্যে নিজের কান ধরিয়ে বলতে বাধ্য করাবে ‘আর সিপিএম করব না’—এই অভিজ্ঞতাও হয়ে গেল তৃণমূল সরকারের আমলে!

Advertisement

জাঠায় যোগ দিতে ঝিকড্ডা পঞ্চায়েতের পারুলিয়া গ্রামের বাড়ি থেকে শনিবার সকাল ৯টার মধ্যেই বেরিয়ে পড়েছিলাম। ঠিক ছিল ময়ূরেশ্বরের গড়গড়া থেকে ষাটপলশা পর্যন্ত মিছিল হবে। সাড়ে ৯টায় গড়গড়ায় পৌঁছে গেলেও মিছিল শুরু হতে ১০টা বেজে যায়। প্রায় এক ঘণ্টা মিছিলে হেঁটেছিলাম। শ’দুয়েক লোক জন নিয়ে আমাদের মিছিল তখন গন্তব্য ষাটপলশায় পৌঁছনোর মুখে। তখনই হামলাটা হল! গোডাউন মোড়ের কাছে আসতেই তৃণমূলের দুষ্কৃতীরা হঠাৎ আক্রমণ চালাল আমাদের মিছিলে। ওরা যেন ওঁত পেতেই অপেক্ষা করছিল। আমি তখন মিছিলের একেবারে সামনের সারিতে। খবর পেলাম, পিছন থেকে মিছিলে হামলা হয়েছে। পিছিয়ে এসে দেখি, বেদম মার খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রয়েছে আমাদের জেলা কমিটির সদস্য অরূপ (বাগ)। ওকে প্রথমে তোলার চেষ্টা করলাম। অরূপ কোনও ক্রমে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু, বেশিক্ষণ পারল না। যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আবার লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ওর মাথা দিয়ে তখন ঝরঝর করে রক্ত পড়ছে।

তত ক্ষণে আমাদের দলের আর এক সক্রিয় কর্মী শিশিরকে (‌দে) ওরা আক্রমণ করেছে। ওর পায়ে-হাতে এমন ভাবে মারল যে, বেচারা আর উঠতেই পারল না। এগিয়ে এসে যে-ই শিশিরকে তোলার চেষ্টা করছি, আমার মাথার বাঁ পাশে কান ঘেঁষে সজোরে চ্যালা কাঠের বাড়ি দিল ওদের এক জন। চোখে যেন অন্ধকার দেখলাম। দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। কিন্তু, ওরা মারধর বন্ধ করেনি। লাঠি, চ্যালা কাঠ আর কিল-লাথি পড়তে থাকল মাথায়, পিঠে, হাতে। তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের হামলায় আমাদের মিছিল তত ক্ষণে পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছে। এ বার আমরা দু’জন অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ালাম।

Advertisement

শিশির ততটা চেনা মুখ নয় এলাকায়। নেতাও নয়। তাই তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের লক্ষ হয়ে দাঁড়ালাম আমি। যেহেতু চার বারের বিধায়ক, জেলার সভাধিপতিও ছিলাম, যত রাগ যেন আমার উপরেই পড়ল। বেধড়ক মার চলতে লাগল। জামা-গেঞ্জি রক্তারক্তি। হাতের আঙুল ভেঙেছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। যখন মনে হচ্ছে, হয়তো আর বাঁচব না, তখন হামলাকারীদের মধ্যেই কে যেন বলে উঠল, ‘থাক! আর মারিস না। বুড়োটা এ বার মরে যাবে’! মার বন্ধ করলেও অন্য হেনস্থা শুরু হল।

জনা ৭-৮ জনের দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল এলাকার তৃণমূল কর্মী তথা সিভিক ভলান্টিয়ার রাম বাগদি। ওকে আগে থেকেই চিনতাম। ষাটপলশার নামোপাড়াতেই ওর বাড়ি। আমার জামা গেঞ্জি টেনে খুলে নিচ্ছিল ওরা। উদ্দেশ্য ছিল, আমাকে নগ্ন করে ঘোরানোর। নিজের বিধানসভা এলাকায় এই অপমান সইতে পারতাম না। এর চেয়ে মরে যাওয়া ভাল! নিজের মান বাঁচাতে তাই নিরুপায় হয়ে আমি ওদের হাতেপায়ে ধরলাম। বললাম, ‘মারধর করেছো, আর এ সব করো না’। তখনই রাম সঙ্গীদের উদ্দেশে বলল, ‘দাঁড়া বেটার কাছ থেকে কী ভাবে জবানবন্দি আদায় করি দ্যাখ’। এই বলেই গালাগাল দিয়ে বলল, ‘কান ধরে ওঠবোস কর। বল আর রাজনীতি করবি না। সিপিএম করবি না। এই এলাকায় আসবি না’। নিজের সম্মান রক্ষায় সেটাই বলতে বাধ্য হলাম। রাম নিজেই মোবাইলে সেই ছবি তুলে রাখল। বেশ কিছু ক্ষণ পরে এক মোটরবাইক আরোহী (মল্লারপুরে বাড়ি, মুখ চেনা, নামটা মনে পড়ছে না) তিনি-ই আমাকে বাঁচালেন। উনি না এলে হয়তো প্রাণেও বাঁচতাম না।

শনিবার দুপুর থেকেই হাসপাতালে ভর্তি। মাথায় অন্তত তিরিশটা সেলাই। শরীরে এখনও অসহ্য ব্যাথা। আমাদের বামপন্থী সংগঠনগুলির জাঠা করার যে উদ্দেশ্য, মানুষের জ্বলন্ত সমস্যা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সেটা করতে গিয়ে শাসকদলের হাতে আক্রান্ত হতে পারি এমন আশঙ্কা ছিল, ছিল মানসিক প্রস্তুতিও। কিন্তু সত্তরোর্ধ্ব বয়সে যে ভাবে ওরা আমার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলল, সে জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। তাই মনের আঘাত শরীরের আঘাতকে ছাপিয়ে গিয়েছে।

(প্রাক্তন বিধায়ক ও সভাধিপতি)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন