Rudraprasad Sengupta

বুঝতাম, আমার পাশে মধুর রয়েছেন

শঙ্খ ঘোষ বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। কিন্তু কখনও সে ভাবনা শ্রদ্ধাবোধে আড়াল তৈরি করেনি।

Advertisement

রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত (নাট্য ব্যক্তিত্ব)

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ এপ্রিল ২০২১ ০৬:২৪
Share:

অন্তিম যাত্রা। বুধবার। নিজস্ব চিত্র।

কোনও সন্দেহ নেই যে, অধিকাংশ মানুষই অসম্পূর্ণ। বেশির ভাগ মানুষ অজান্তেই আধেক হয়ে ওঠার সাধনায় জীবন পণ করেন। ব্যতিক্রমও আছে। তবে, সেই সংখ্যা হাতেগোনা। কারণ, ভাল মানুষের সংখ্যা কম। ভাল মানুষ পূর্ণতার সন্ধানী। এমনই ব্যতিক্রমী এক ভাল মানুষ, সমাজের একজন সত্য অভিভাবক চলে গেলেন। ‘অপূরণীয়’ শব্দটি এই ক্ষতির ক্ষেত্রেই মানায়।

Advertisement

শঙ্খ ঘোষ বয়সে আমার চেয়ে সামান্য বড়। কিন্তু কখনও সে ভাবনা শ্রদ্ধাবোধে আড়াল তৈরি করেনি। কারণ, মানুষ হিসেবে যে তিনি অনেক-অনেক বড়! এমন একজন মানুষ, যাঁর কথা জীবনের অসংখ্য প্রতিবন্ধকতার সময় মনে পড়েছে, একাকিত্বের মুহূর্তে আশ্রয় হয়ে উঠেছেন যিনি বার বার। এমন একজন মানুষ, যাঁকে দিশা মানলে মন শান্ত হয়, পথে পথে ছড়িয়ে থাকা পাথর গলে যায়। ঝড়ের মধ্যেও দৃঢ়, আঁধারের মধ্যেও ধ্রুবতারা— এমন মানুষের চলে যাওয়া সামাজিক দুর্ভাগ্যই।

স্মৃতির ভাণ্ডার উপচে পড়ে তাঁর কথা লিখতে গেলে। চোখের জলের জোয়ার লাগে। মনে হয়, কত-কত কিছু শেখা বাকি থেকে গেল! নরম অথচ ঋজু এমন অভিভাবক-বন্ধু আর ক’টা পাওয়া যায়! তাঁর প্রতিবাদী চারিত্রের কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, সে প্রতিবাদ হৃদয়ের ভিতর থেকে উৎসারিত হত, তা কখনওই নিছক বাহ্যিক অভিমত নয়। একটি প্রতিবাদ মিছিলের কথা মনে পড়ছে। কলেজ স্কোয়্যার থেকে এসপ্লানেড। প্রচণ্ড গরমে পদযাত্রা। শঙ্খ ঘোষ হাঁটছেন। পাশাপাশি আমরাও অনেকে। অসুবিধা হলে গাড়ির ব্যবস্থাও ছিল। ওঁকে খুব ঘামতে দেখে জানতে চাইলাম— গাড়িতে যাবেন, শঙ্খদা? অল্প হেসে না বললেন। পুরোটাই হাঁটতে হাঁটতে গেলেন সেই অশক্ত শরীরে।

Advertisement

আমারও বয়স হয়েছে। কেউ কেউ চেনেনও আমায়। সেই সূত্রেই চারপাশে কিছু ঘটলে আমার মতামত নিতে অনেকে আসেন, ফোন করেন। আগে-আগে বলতাম। বেশ কিছু দিন ধরে অন্য পন্থা নিয়েছিলাম। আমার মত জানতে চাইলে উল্টে জানতে চাইতাম— আপনারা শ্রীশঙ্খ ঘোষের অভিমত পেয়েছেন? কী বললেন উনি? এ পন্থায় খুব উপকার হয়েছিল আমার। ঢাল হিসেবে শঙ্খ ঘোষ আমায় যেন বাঁচিয়ে দিতেন। অর্থাৎ, ভেবেচিন্তে কথা বলা, প্রয়োজনে শব্দহীন হওয়াও। এ শিক্ষা ওঁরই।

তাঁর সাহিত্যকাজ, শিক্ষক হিসেবে তাঁর ভূমিকা— এ সব নিয়ে নতুন করে লেখার কিছু নেই। তাঁর নাট্যপ্রীতি নিয়েও অজানিত নেই কিছু। তবু বলা জরুরি নাট্য ও শিল্পকলার সঙ্গে তাঁর আত্মীয়তার কথা। সে আত্মীয়তা নিখাদ। শঙ্খদা নাটক অনুবাদ করেছেন। প্রচুর নাটক দেখতেন। শুধু যে নামী নাট্যদলের প্রযোজনা, তা মোটেই নয়। নবীন দলের প্রযোজনাও দেখতেন। এটা মোটেই ভদ্রতা নয়, শিল্পের সমস্ত শাখার প্রতি টান। ‘নান্দীকার’-এর নতুন নাটকের মহড়ায় শঙ্খদার কাছে আবদার থাকত দেখে পরামর্শ দেওয়ার। একটি নাটকের কথা মনে পড়ছে। ‘এই শহর এই সময়’। সে প্রযোজনা ছিল কবিতা-নির্ভর। মহড়ায় উপস্থিত শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী। তাঁদের বহু কবিতাও সে প্রযোজনায় গ্রন্থিত। আমি আড়চোখে দেখছিলাম। কোনও জায়গায় শঙ্খদা আবেগাপ্লুত হলেন। কিন্তু কী তার প্রকাশ? আহা-আহা করে ওঠা? মোটেই নয়। অভিনয়ে কোনও বিঘ্ন ঘটানো নয়। ওঁর হাত দু’টি কখনও একে অপরের উপর এসে পড়ছে। কখনও ঠোঁটের কোণে, চোখের অপাঙ্গে এসে দাঁড়াচ্ছে অভিব্যক্তি। ‘শঙ্খপুরের সুকন্যা’ প্রযোজনা ছিল সঙ্গীতময়। তার মহড়াতেও শঙ্খ ঘোষের অভিব্যক্তি নান্দীকারের সে সময়ে উপস্থিত কারও ভোলার নয়।

এক অন্য অনুভূতি ওই মানুষটিকে ঘিরে। জীবনে খুব অল্প বয়সে মাকে হারিয়েছি, দাদাকে সে ভাবে পাইনি। শঙ্খদাকে পেয়েছিলাম। হাতটা ধরে অল্প চাপ দিলেই বুঝতাম, আমার পাশে মধুর রয়েছেন! নিশ্চিন্ত হতাম! এত বড় মাপের ব্যক্তিত্ব, এত ব্যস্ততা, কিন্তু কী শান্তভাব! অজস্র মানুষের বিপন্ন মুহূর্তে সেই ভাব শান্তিবারি হয়ে নেমে এসেছে।

ভাষা, সাহিত্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞান— সব বিষয়েই আমরা বিদেশ তোলপাড় করে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব খুঁজি। তাতে অসুবিধার কিছু নেই। কিন্তু আক্ষেপ— ইংল্যাল্ডের দুর্বল কবির নাম জানলেও আমরা বোধ হয় ঠিক ভাবে চিনেই উঠতে পারলাম না শঙ্খ ঘোষের কলমকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন