ময়দানে প্যাটিস বিক্রি করার সময় নানা প্রশ্নের সম্মুখীন শেখ রিয়াজুল। —ফাইল চিত্র।
ভোর হলেই কলকাতার দিকে রওনা হতেন। ময়দান থেকে খিদিরপুরের ফ্যান্সি মার্কেট ঘুরে ঘুরে প্যাটিস বিক্রি করতেন শেখ রিয়াজুল। গত ২২ বছর এটাই তাঁর রোজনামচা। সেই প্রৌঢ় এখন কলকাতার দিকে পা বাড়াতেই ভয় পাচ্ছেন। তিনি বলছেন, ‘‘ভেবেছিলাম, ১৩ ডিসেম্বর যুবভারতীতে যাব। (লিওনেল) মেসি, শাহরুখ (খান) আসবে। কিন্তু ভয়ও করছে। সকলেই তো দেখেছে, মার খাচ্ছি। কান ধরে ওঠবস করছি...।’’ বলতে বলতে কান্নায় গলা বুজে আসে হুগলির আরামবাগের প্যাটিস বিক্রেতার।
ময়দানে প্যাটিস-কাণ্ডে তিন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। তাঁরা জামিনও পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে যায় আসে না আরামবাগের পূর্ব কেশবপুরের আহিনাপাড়ার বাসিন্দা রিয়াজুলের। তিনি বলছেন, সম্মানহানির কথা। শুক্রবার বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে প্রৌঢ় জানান, পুজোপার্বণ, মেলা, সভা-সহ নানা ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবে ঘুরে ঘুরে গত দু’দশক প্যাটিস বিক্রি করেছেন। কিন্তু গত রবিবারের মতো ঘটনার সম্মুখীন হননি তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘খুব আতঙ্কে আছি। কলকাতায় প্যাটিস বিক্রি করতে যেতেই ভয় পাচ্ছি। আগে তো কখনও এমন হয়নি।’’ তাঁর রোজগারেই সংসার চলে। কিন্তু স্ত্রী-সন্তানও চাইছেন না আর কলকাতা যান রিয়াজুল।
রবিবার ব্রিগেডে ‘৫ লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ’ অনুষ্ঠানে তাঁর উপর হামলার কথাই ঘুরেফিরে আসছে রিয়াজুলের মাথায়। সে দিন রিয়াজুলের সঙ্গে তপসিয়ার মহম্মদ সালাউদ্দিনকে হেনস্থা করেন কয়েক জন। অভিযোগ, গীতাপাঠের অনুষ্ঠানের শামিল হওয়া কয়েক জন তাঁদের প্যাটিস ফেলে দেওয়ার পাশাপাশি মারধরও করেন। রিয়াজুলের দাবি, প্রায় ৩ হাজার টাকার খাবার নষ্ট হয়েছে তাঁর। তিনি জানান, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কাউকে মিথ্যে বলে চিকেন প্যাটিস বিক্রি করেননি। উল্টে সে দিন ভেজ প্যাটিসের চেয়ে চিকেন প্যাটিসই বিক্রি হয়েছিল বেশি। রিয়াজুলের কথায়, ‘‘ডজন তিনেক প্যাটিস বিক্রি হয়েছিল। চিকেন প্যাটিস ছিল বেশি। কাউকে মিথ্যা বলে মাল বেচিনি। কিন্তু হঠাৎ আমার নাম জিজ্ঞাসা করে মাল নষ্ট করে দিল কয়েক জন। মারধর করল।’’
এখনও আতঙ্কিত আরামবাগের প্যাটিস বিক্রেতা শেখ রিয়াজুল। —নিজস্ব চিত্র।
অভিযুক্তেরা তো গ্রেফতার হয়েছিলেন। স্বস্তি পেয়েছেন? ঝাঁজিয়ে ওঠেন রিয়াজুল। ‘‘কীসের স্বস্তি? আমি খাটলে বাড়ির লোক খেতে পায়। সেই আমি কাজে যেতে ভয় পাচ্ছি। আমার মাল নষ্ট করেছে। যা ক্ষতি হওয়ার তো হয়েইছে। আমায় মারধর করল। কান ধরে ওঠবস করানো হল। সকলে সেই ছবি (সমাজমাধ্যমে) দেখেছে। সেই অসম্মানের দাম কে দেবে? তার দাম হয়?’’
রিয়াজুলকে ছাড়তে ভয় পাচ্ছেন স্ত্রী-ও। তাঁর কথায়, ‘‘ওকে তো সবাই চিনে ফেলেছে। আবার যদি মারে?’’ রিয়াজুলের অশীতিপর বাবা জিয়ানুল আবেদিনও এক সময়ে কলকাতায় প্যাটিস বিক্রি করতেন। ছেলে কী অপরাধ করছে, সেটাই মাথায় ঢুকছে না বৃদ্ধের। তিনি বলেন, ‘‘সিনেমা হলের সামনে প্যাটিস বিক্রি করতে গিয়ে অনেক বার টিকিট ব্ল্যাকারদের সঙ্গে ঝগড়া-ঝামেলা হয়েছে। কিন্তু কখনও খাবার বিক্রি করার জন্য কেউ তো মারধর করেনি।’’
রিয়াজুলকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছে শাসকদল। তৃণমূল নেতারা বলছেন,তাঁরা পাশে আছেন। তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক স্বপন নন্দী বাড়িতে গিয়ে রিয়াজুলের সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু তাতেও আতঙ্ক কাটেনি রিয়াজুল ও তাঁর পরিবারের।
অন্য দিকে, বিজেপির দাবি, সিরাজুলদের দিয়ে পরিকল্পনা করে গন্ডগোল করানো হয়েছে। আরামবাগের বিধায়ক মধুসূদন বাগের মন্তব্য, ‘‘যেখানে সনাতনী হিন্দু সমাজের পাঁচ লক্ষ কণ্ঠে পবিত্র গীতাপাঠ হচ্ছে, সেই অনুষ্ঠানকে বানচাল করার জন্য পরিকল্পিত চক্রান্ত করে নিরামিষ খাবারের পরিবর্তে আমিষ খাবার বিক্রি করা হচ্ছিল। কিন্তু শাসকদলের সেই চক্রান্তের ফাঁদে পা দেননি কেউ।’’