Uluberia

সম্বল ভাড়ায় নেওয়া টোটো, লড়ছেন অঞ্জলি

লড়াই যতই কঠিন হোক না কেন, সূচাগ্র জমিও ছাড়তে নারাজ অঞ্জলি দাস।

Advertisement

রাজীব চট্টোপাধ্যায়

উলুবেড়িয়া শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১০:৪৬
Share:

যোদ্ধা: সওয়ারি নিয়ে অঞ্জলি। —নিজস্ব চিত্র

নিজের বাড়ি নেই। নেই এক চিলতে জমিও। ঘরে রয়েছেন মানসিক ভারসাম্য হারানো মা আর লকডাউন-এ কাজ হারানো স্বামী। বোনের স্বামীর মৃত্যুর পরে তাঁদের এক সন্তানের দায়িত্বও নিতে হয়েছে। লড়াই যতই কঠিন হোক না কেন, সূচাগ্র জমিও ছাড়তে নারাজ অঞ্জলি দাস। উলুবেড়িয়া শহরের একমাত্র মহিলা টোটোচালক অঞ্জলির সঙ্গে লড়াইয়ে পিছু হটছে যাবতীয় প্রতিকূলতা।
‘‘মায়ের জন্য মাসে ওষুধ কিনতে খরচ হয় প্রায় হাজার টাকা। বোনের ছেলেটাকে পড়াশোনা করাই। ঘর ভাড়া দিই পনেরোশো টাকা। লকডাউন চলার সময়ে স্বামীর কাজটাও চলে চলে যায়। তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কী করব, কোথায় যাব, ভাবতে পারছিলাম না। তখনই ঠিক করি টোটো চালাব,’’ বললেন উলুবেড়িয়া পুরসভার দুর্গামন্দির এলাকার বাসিন্দা বছর পঁয়ত্রিশের অঞ্জলি।
বছর দেড়েক আগে টোটো চালানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন অঞ্জলী অঞ্জলি । লকডাউন প্রত্যাহারের পরে গত অক্টোবর থেকে টোটো চালাচ্ছেন। যদিও টোটোটি তাঁর নিজের নয়। টোটোর মালিককে রোজ ২০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়। তারপর হাতে যে টুকু থাকে তা দিয়ে সংসার চালান অঞ্জলি। বলেন, ‘‘হাতে কোনও দিন ২০০ টাকা বা কোনও দিন আড়াইশো টাকা থাকে। কোনও কোনও দিন একশো টাকাও আসে না। এখন বাজারে অনেক টোটো হয়ে গিয়েছে। কখনও লঞ্চঘাট, কখনও নর্থমিল—যাত্রী ধরতে বিভিন্ন এলাকায় ঘুরি।’’
একটি মাত্র ঘরে কোনওরকমে মাথা গুঁজে থাকতে হয় অঞ্জলিদের। বাড়িতে শৌচালয়টুকুও নেই। শৌচকর্ম বা স্নানের জন্য যেতে হয় এলাকার একটি শৌচালয়ে। অঞ্জলি বলেন, ‘‘আমি ছোটবেলা থেকেই জেদি। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুর হয়। তারপর আর পড়াশোনা হয়নি। তখনই মায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। বোনের স্বামীর মৃত্যুর পরে মা সম্পূর্ণ ভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তখন থেকেই হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে চলেছি। আগে পরিচারিকার কাজ করতাম।’’
রোজ ভোর সাড়ে চরটে নাগাদ টোটো নিয়ে পথে বেরিয়ে পড়েন অঞ্জলি। ফেরেন সকাল আটটা নাগাদ। রান্নাবান্না ও বাড়ির কাজকর্ম কিছুটা সেরে ফের টোটো নিয়ে বেরিয়ে যান বেলা ১০টায়। দুপুরের খাবার খেতে বাড়ি আসেন আড়াইটে নাগাদ। ঘণ্টাখানেক বিশ্রামের পরে ফের টোটো নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ফেরেন রাত আটটায়।
অঞ্জলি বলেন, ‘‘প্রথম যেদিন টোটো চালানো শুরু করেছিলেলাম, সে দিন কটাক্ষের সুরে অনেকে বলেছিলেন, ‘আরও কত কিছু যে দেখতে হবে, কে জানে।’ এখন তাঁদের অনেকে আমাকে বলেন, ‘ দিদি, আমরা তোমার পাশে আছি। প্রয়োজন হলে জানিও।’ ভাল লাগে এই পরিবর্তন দেখে।’’
অঞ্জলির বোনের ছেলে নবম শ্রেণির ছাত্র। তাকে উচ্চশিক্ষিত করতে চান তিনি। অঞ্জলি বলেন, ‘‘এখন আমার স্বামী মাছ বিক্রি শুরু করেছেন। পুঁজি নেই। সামান্য কিছু মাছ জোগাড় করে বিক্রি করেন।’’ অঞ্জলির অদম্য জেদ এবং পরিশ্রম করার ক্ষমতাকে কুর্নিশ জানিয়েছেন অনেকে। উলুবেড়িয়ার বাসিন্দা পেশায় শিক্ষক তুষারকান্তি মণ্ডল বলেন, ‘‘মেয়েটি খুবই গরিব। ওর পরিশ্রম করার ক্ষমতা অসীম। পরিবার চালাতে ও যে ভাবে লড়ছে, তাকে আমরা সম্মান করি। ওর পাশে আমরা থাকব।’’
লকডাউনে অনেকের মতো সমস্যায় পড়েছিল অঞ্জলির পরিবারও। মায়ের শরীর এবং পারিবারিক অবস্থার কথা তুলে ধরে ফেসবুকে একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছিলেন তিনি। সেটা দেখে বেশ কয়েক জন তাঁর সাহায্যে এগিয়ে আসেন। অঞ্জলির অভিযোগ, ‘‘প্রশাসনের থেকে কোনও সাহায্য পাইনি।’’ টোটোচালানোর প্রশিক্ষণ নেওয়ার পরে ঋণ নিয়ে টোটো কেনার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু প্রয়োজনীয় সাহায্য তিনি পাননি।
অঞ্জলির পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন উলুবেড়িয়া পুরসভার প্রশাসকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান অভয় দাস। তিনি বলেন, ‘‘কোনও স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত করে ওঁর জন্য ঋণের ব্যবস্থা যাতে করা যায়, সেই চেষ্টা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন