অ্যাসিডে চোখ খুইয়ে আঁধারে লড়াই ঝুমার

প্লাস্টিকের ব্যাগে কাগজের তাড়া। তাতে আছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতিলিপিও। যাতে বলা হয়েছিল, অ্যাসিড-আক্রান্তদের কম করে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ছাড়াও নিখরচায় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হবে যে-কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে।

Advertisement

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:০৩
Share:

রিষড়ার বাড়িতে ছেলের সঙ্গে ঝুমা। স্বাতী চক্রবর্তীর তোলা ছবি।

প্লাস্টিকের ব্যাগে কাগজের তাড়া। তাতে আছে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রতিলিপিও। যাতে বলা হয়েছিল, অ্যাসিড-আক্রান্তদের কম করে তিন লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ছাড়াও নিখরচায় চিকিৎসার বন্দোবস্ত করতে হবে যে-কোনও সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে।

Advertisement

অ্যাসিডে জ্বলে গিয়েছে তাঁর চোখের তারা। তবু অন্ধকারে সেই কাগজটুকু আঁকড়েই দোরে দোরে ঘুরছেন নাছোড় তরুণী। তাঁর নাম ঝুমা সাঁতরা। ২০১৪-র ডিসেম্বরে শ্বশুরবাড়ির এক পড়শির ছোড়া অ্যাসিডে ঝুমার দুই চোখ-সহ গোটা মুখটাই পুড়ে গিয়েছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মাস পাঁচেক আগে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে ন্যূনতম সরকারি ক্ষতিপূরণ মিলেছে। কিন্তু জীবনটা এখনও গভীর অন্ধকারে মোড়া।

অ্যাসিড ছোড়ার অভিযোগে মিন্টু মান নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু অ্যাসিড কাণ্ডের পরে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক কার্যত ঘুচে গিয়েছে রিষড়ার ঝুমার। বাপের বাড়িতে আশ্রিত ওই তরুণীর একমাত্র ছেলের এ বার মাধ্যমিকে বসার কথা ছিল। তাকে ঢুকতে হয়েছে গেঞ্জির কারখানায়। অস্ত্রোপচারে দৃষ্টি ফিরে পেতে চেন্নাই-কলকাতা ঘুরপাক খাচ্ছেন দিশাহারা ঝুমা।

Advertisement

ক্ষতিপূরণের তিন লক্ষ টাকা হাত থেকে গলে যাচ্ছে জলের মতো। ধারদেনা, সংসার-খরচ তো আছেই! মাসখানেক আগে চেন্নাইয়ে গিয়ে শুনেছেন, অস্ত্রোপচার করে একটা চোখের পাতা বসাতেই ৮০ হাজারের ধাক্কা। তার পরে অন্য চোখ। তাতে কিছু ফল মিললেও মিলতে পারে। এক বার চেন্নাই গিয়েই ঝুমা বুঝেছেন, খরচ হবে অনেক বেশি। ঝুমা আর তাঁর মা পাড়ার এক প্রৌঢ়কে নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁকে মোটা টাকা দিতে হয়েছে। তার উপরে থাকা-খাওয়া, যাতায়াত, ডাক্তার দেখানো এবং ছোটখাটো কিছু পরীক্ষা বাবদ হাজার ৩০ টাকা ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে।

চেন্নাই যাওয়ার আগে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতেও কম হ্যাপা পোহাতে হয়নি ওই তরুণীকে। ব্যাঙ্ক সপ্তাহে ২৪ হাজারের বেশি টাকা দেবে না কিছুতেই। ওইটুকুতে হবেটা কী! ঝুমা কান্নাকাটি করে আরও কিছু বেশি জোগাড় করেন। চেন্নাইয়ে গিয়ে খরচের বহর শুনে ফিরে আসতে হয়েছে। অস্ত্রোপচার হয়নি। ‘‘চোখ সারাতে আমাকে চেন্নাইয়েই যেতে হবে! কিন্তু টাকাটা কী ভাবে আসবে, ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছি না,’’ অগাধ জলে পড়ে বলছেন ঝুমা। ডাক্তারেরা মাসখানেকের ওষুধ দিয়েছিলেন। সেই ওষুধ এ দিকে ফুরোতে চলল।

ঝুমার অবস্থাটাই বলে দিচ্ছে, রাজ্যে অ্যাসিড-আক্রান্তদের হাল কী। ২০১৪-’১৫, দু’বছরে ৪১ জন করে অ্যাসিড-হামলার শিকার হয়েছেন এ রাজ্যে। ২০১৬-য় সংখ্যাটা তার দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছে বলে জানাচ্ছে অ্যাসিড-আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানো একটি সংগঠন। তারা মানছে, আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র কয়েক জন ক্ষতিপূরণ পান। দরকারের সময়ে সেই আক্রান্তদের পাশে সচরাচর কাউকে পাওয়া যায় না। গত বছর অনেক দৌড়ঝাঁপের পরে রাজ্যের আট জন অ্যাসিড-আক্রান্ত মেয়ে ক্ষতিপূরণের ন্যূনতম তিন লক্ষ টাকা পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক একটি রায় কিন্তু বলছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অ্যাসিড-আক্রান্তদের দরকার এর ঢের বেশি। বিহারেই দুই বোনকে ২০১৫-র শেষে ১৩ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে বলেছিল সর্বোচ্চ আদালত। সেই সঙ্গে কোনও হাসপাতাল অ্যাসিড-আক্রান্তদের নিখরচায় চিকিৎসা না-করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়।

ঝুমাদের সমস্যা অবশ্য তাতেও মিটছে না। ঝুমার হয়ে মামলা লড়তে এগিয়ে আসা একটি মানবাধিকার সংগঠনের আইনজীবী পৃথা ভৌমিক বলেন, ‘‘ক্ষতিপূরণের অঙ্ক ভবিষ্যতে বাড়ার সম্ভাবনা আছে।’’ তা ছাড়া চিকিৎসা খাতে মেয়েটির যা খরচ হচ্ছে, তা পরে মিটিয়ে দেওয়ার কথা রাজ্য সরকারের। কিন্তু বাস্তবে এই কথা কে কবে কী ভাবে রাখবে, তার সদুত্তর নেই কারও কাছেই। অ্যাসিড-আক্রান্তদের কার কী সমস্যা, তা খতিয়ে দেখতে ডিজএবিলিটি বোর্ড গড়তে বলেছিলেন বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত। ২০ জানুয়ারি সেই বোর্ডের শুনানি হওয়ার কথা। সে-দিকেই তাকিয়ে অ্যাসিড-দগ্ধ মহিলারা।

দৃষ্টি ফিরে পাওয়ার ক্ষয়ে যাওয়া আশা নিয়ে ঝুমাও অপেক্ষা করছেন রিষড়ায় বাপের বাড়ির চিলতে ঘরে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন