‘ও শুধু বলত, লোকটা মরে গেল! কিন্তু নিজেকে শেষ করে দেবে, ভাবিনি’

গারো দিন আগে উত্তরপাড়ার সরোজ মুখার্জি স্ট্রিটে ভাঙা বাড়ির চাঙড় খসে মারা যান সুকুমার দাস নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা।

Advertisement

প্রকাশ পাল 

উত্তরপাড়া শেষ আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০১৮ ০৫:৫২
Share:

আকস্মিক: সতীনাথবাবুর স্ত্রী ও মেয়ে। ছবি: দীপঙ্কর দে

একই ঘটনার অভিঘাত কার্যত একই সরলরেখায় এনে দাঁড় করিয়ে দি‌য়েছে উত্তরপাড়ার একই এলাকার দু’টি পরিবারকে! আলো নিভে গিয়েছে দুই পরিবারেই।

Advertisement

এগারো দিন আগে উত্তরপাড়ার সরোজ মুখার্জি স্ট্রিটে ভাঙা বাড়ির চাঙড় খসে মারা যান সুকুমার দাস নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা। অথৈ জলে পড়ে তাঁর পরিবার। ন্যূনতম সাবধানতা ছাড়াই বাড়ি ভাঙার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার পর থেকেই মুষড়ে পড়েছিলেন অভিযুক্ত ঠিকাদার সতীনাথ পাত্র। শুক্রবার রাতে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। তাতে যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে পাত্র পরিবারের মাথায়! বাড়ির লোকেরা জানান, বিবেকের দংশনে শুক্রবার রাতে তিনি বিষ খেয়ে আত্মঘাতী হন।

উত্তরপাড়ার সরোজনাথ মুখার্জি স্ট্রিটের একচিলতে গলিতে সতীনাথবাবুদের দোতলা পৈতৃক বাড়ি। একতলায় স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁর। দোতল‌ায় তাঁর দাদার পরিবার থাকে। স্ত্রী অঞ্জলি উত্তরপাড়া-কোতরং পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। বছর নয়েক ধরে উত্তরপাড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে আয়ার কাজ করেন। বড় মেয়ে বিপাশা শহরের অমরেন্দ্র বিদ্যাপীঠ ফর গার্লসের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী। ছোট মেয়ে তিয়াশা একই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে।

Advertisement

রবিবার সকালে ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, দরজার মুখেই সিঁড়ির কাছে কয়েক জন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে। অঞ্জলি জানান, ২০ সেপ্টেম্বর দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ভেঙে পড়েছিলেন স্বামী। অঞ্জলির কথায়, ‘‘ও শুধু বলত, লোকটা (সুকুমার দাস) প্রাণে মরে গেল! হাত-পা ভেঙে গেলেও বুঝতাম! ঘটনাটা ওঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। গত দু’দিন ধরে চাপা কষ্টটা বাড়ছিল, বুঝতে পারি। কিন্তু নিজেকে এ ভাবে শেষ করে দেবে, ভাবিনি।’’

পুরনো এই বাড়ি ভেঙেই ঘটেছিল দুর্ঘটনা। ছবি: দীপঙ্কর দে

বাবার মৃত্যু নাড়া দিয়ে গিয়েছে দুই মেয়েকেও। বিপাশা ব‌লে, ‘‘শুক্রবার সন্ধ্যায় আমি আর বোন পড়তে গিয়েছিলাম। মায়ের নাইট ডিউটি ছিল। বাবা বাড়িতে একাই ছিলেন। সেই সময়েই বিষ খায়। আমরা রাতে ফিরে এসে বাবার সঙ্গে গল্পগুজব করি। ঘুণাক্ষরেও বিষ খাওয়ার কথা বলেনি। বেশি রাতে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।’’ বিপাশার কথায়, ‘‘বাবা আমাদের খুব ভাল বন্ধু ছিল। সব সময় ভাল মানুষ হওয়ার কথা বলত। পড়াশোনা করে বাবার কথা রাখব।’’

পাত্র বাড়িতেই ছিলেন ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর সুমিত চক্রবর্তী ওরফে টুকাই। তিনি বলেন, ‘‘সতীনাথ আমাদের দলের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। ওঁর শ্রমিকেরা সে দিন ইট-রাবিশ সরানোর কাজ করছিলেন। তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে যায়। ওঁর বিরুদ্ধে এফআইআর হওয়ায় সতীনাথ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই দিনই জামিন পান। তার পরেও মনমরা ছিলেন।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘অঞ্জলির সব প্রয়োজনে পাশে থাকব। ওঁর মেয়েদের পড়াশোনার ক্ষেত্রেও দরকারে সাহায্য করব।’’

অঞ্জলি বলেন, ‘‘আমি কাউন্সিলর হলেও ও আমার অনেকটা কাজ করে দিত। এখন মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার পাশাপাশি মেয়েদের মানুষ করতে হবে। তবে এখন কিছু ভাবতে পারছি না। পারলৌকিক কাজের পরে সব ঠিক করব।’’

সতীনাথবাবুর বাড়ির কাছে সেই ভাঙা বাড়ি থেকে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়া চাঙড় এখনও রাস্তাময় ছড়িয়ে। দু’পাশে পুলিশের ব্যারিকেড। রাস্তা বন্ধ। স্থানীয় এক প্রৌঢ়ের স্বগতোক্তি, ‘‘বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে দু’টো পরিবারকেই এই দিন দেখতে হত না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন