সামান্য বৃষ্টিতেই এমন চেহারা হয় আরামবাগের বিবেকানন্দ পল্লির রাস্তাঘাটের। ছবি: মোহন দাস।
শহর জুড়ে নিকাশি-নালাগুলির বেহাল অবস্থা পাল্টায়নি পাঁচ বছরেও।
অথচ, পুরবোর্ড পাল্টে গিয়েছে দু’-দু’বার। যখন যে পক্ষ ক্ষমতায় এসেছে, মূল প্রতিশ্রুতি হিসেবে তাদের মূখে শোনা গিয়েছে নিকাশি-নালা সংস্কারের কথা। কিন্তু সেই কাজ সম্পূর্ণ হয়নি।
দেখতে দেখতে আরও একটি পুর নির্বাচন। অবশ্য আরামবাগে তা হবে নাম-কা-ওয়াস্তেই। কেননা, ইতিমধ্যেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৯টির মধ্যে ১৬টি ওয়ার্ডে জিতে গিয়েছে তৃণমূল। পুরবোর্ডে ফের তারাই ক্ষমতায় আসতে চলেছে। নতুন পুরবোর্ডের কাছেও শহরবাসীর মূল প্রত্যাশা সেই একই— নিকাশি-নালার সংস্কার। কেননা, বেহাল নালাগুলির কারণে ফি-বছর বর্ষায় প্লাবিত হয় শহরের নানা এলাকা। পুরবোর্ড কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ের আনন্দে মশগুল তৃণমূল নেতারা যথারীতি এ বারও নিকাশি-নালা সংস্কারের আশ্বাস দিচ্ছেন। কিন্তু ভরসা করতে পারছেন না শহরবাসীদের অনেকে। তাঁদের বক্তব্য, এমন প্রতিশ্রুতি আগেও শোনা গিয়েছিল। এ বার না আঁচালে বিশ্বাস নেই।
পাঁচ বছর আগের পুর নির্বাচনে হুগলির ১২টি পুরসভা তৃণমূলের দখলে চলে গেলেও আরামবাগ পুরসভার ক্ষমতা বামেরা ধরে রাখতে সমর্থ হয়। সেই সময় তারা শহরের উন্নয়নের যে সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তার মধ্যে ছিল নিকাশি নালা সংস্কারও। বাম পুরবোর্ড আবাসন এবং বৃদ্ধাশ্রম নির্মাণ, পানীয় জলের জন্য একাধিক গভীর নলকূপ বসানো, বিভিন্ন ওয়ার্ডের কবরস্থান এবং শ্মশান সংস্কার, বিশালাক্ষী মন্দির-সহ শহরের প্রাচীন স্থাপত্যের সংস্কার এবং সংরক্ষণের কাজ করে। নিকাশি ব্যবস্থার হাল ফেরানোর জন্য বিভিন্ন ওয়ার্ডে নালা চওড়া করার কাজেও হাত দিয়েছিল তারা।
কিন্তু ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরসভা তৃণমূলের দখলে চলে যায়। ভাইস-চেয়ারম্যান দীপক সরকার-সহ ৬ জন বাম কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেওয়ায় বাম বোর্ড সংখ্যালঘু হয়ে যায়। চেয়ারম্যান গোপাল কচ পদত্যাগ করেন। শহরের মূল সমস্যার সমাধান আর করে উঠতে পারেনি বাম পুরবোর্ড। গোপালবাবু বলেন, ‘‘কাজের পরিবেশ ছিল না। আবাসন এবং বৃদ্ধাশ্রমের কাজ সম্পূর্ণ হলেও বাকি কাজ শেষ করার সময় পাইনি।’’
পুরবোর্ডের দখল নিয়ে তৃণমূল নিকাশি ব্যবস্থার কী করল?
বর্ষায় জমা জল যাতে সহজে কানা দ্বারকেশ্বর খালে গিয়ে মিশতে পারে, সে জন্য ২০১৪ সালের ১২ জুন ঢাকডোল পিটিয়ে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা তৈরির কাজ শুরু করে তৃণমূলের পুরবোর্ড। তালতলা বাজার থেকে আরামবাগ রেল কালভার্ট পর্যন্ত ২ হাজার ৭৫ মিটার লম্বা নালাটি তৈরির জন্য খরচ ধরা হয় ৩ কোটি ৭২ লক্ষ ১৬ হাজার ৬৭৭ টাকা। সে দিন চেয়ারম্যান স্বপন নন্দী ৪৫ দিনের মধ্যে কাজ শেষের আশ্বাস দিয়ে দাবি করেছিলেন, বিশ্বমানের বিশেষজ্ঞদের দিয়ে সমীক্ষা করানো হয়েছে। কিন্তু মাস খানেক পরেই সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কিছু দিন আগেই বৃষ্টিতে ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তালতলা বাজার এবং সংলগ্ন এলাকায় জল জমে যায়। বিক্ষোভ দেখান ব্যবসায়ীরা। নিকাশি নিয়ে পুরসভার বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগই তোলেন তাঁরা। তাঁদের দাবি, পরিকল্পনাহীন ভাবে ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালা করতে গিয়েই বৃষ্টিতে বিপত্তি ঘটছে শহরের।
পানীয় জল নিয়ে শহরবাসীর তেমন অভিযোগ নেই। সমস্ত ওয়ার্ডেই কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে। বসানো হয়েছে আলো। তৈরি হয়েছে গরিবদের বাড়ি, সুলভ শৌচাগার, সুইমিং পুল, বোট ক্লাব, স্পোর্টস কমপ্লেক্স, একাধিক শিশু উদ্যান, বেশ কিছু মার্কেট কমপ্লেক্স। শুধু মূল সমস্যা নিকাশিরই যা সমাধান হয়নি! শহরবাসীর অনেকেই চান, এ বার নতুন বোর্ড সেই সমস্যা মেটাক।
৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা, আরামবাগ গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘‘শহরের দীর্ঘদিনের নিকাশি সমস্যা মেটানোর ব্যাপারে কোনও দিনই সুপরিকল্পিত ভাবে সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বার সেটা নেওয়া হোক। নতুন বোর্ডের কাছে সেই প্রত্যাশা রইল।’’ একই সুরে ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বেনেপুকুরের বাসিন্দা, সব্জি ব্যবসায়ী স্বপন অধিকারী বলেন, ‘‘একটু বৃষ্টিতেই এখানে জল জমে। বামেরা তো করেইনি, তৃণমূলের বোর্ডও এ নিয়ে গুরুত্ব দেয়নি। জানি না এ বার হবে কি না।’’
তৃণমূল নেতাজেরে অবশ্য দাবি, এ বার উন্নয়নে তাঁরা ‘পাখির চোখ’ করবেন নিকাশিকেই। বিদায়ী পুর-চেয়ারম্যান তৃণমূলের স্বপন নন্দীর দাবি, ‘‘ভূগর্ভস্থ নিকাশি নালার কাজ মাত্র ৩০ শতাংশ বাকি। বোর্ড গঠন হলেই ওই কাজে হাত দেওয়া হবে। মানুষের আক্ষেপ আর থাকবে না।’’
অপেক্ষায় রয়েছেন শহরবাসী।