উদ্বেগ জিইয়ে রেখেই খেলায় মন

ভোট খতম। কিন্তু টেনশন তো এখনও তালাবন্ধ ভোট মেশিনে। তাই কর গুনে দিন কাটছে ওঁদের, আর কত দিন! হাপিত্যেশ করে বসে থাকা প্রার্থীদের কথা আনন্দবাজারের পাতায়। সামনেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হবে। পড়ুয়াদের ফল কী হবে তা নিয়ে সমান ভাবে চিন্তিত অভিভাবকেরা। তবে সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও সমান ভাবে চিন্তায় রয়েছে আরও এক শ্রেণির পরীক্ষার্থী।

Advertisement

নুরুল আবসার l

জয়পুর  শেষ আপডেট: ০৭ মে ২০১৬ ০১:৫৪
Share:

(বাঁ দিকে) খেলায় মজে অসিত মিত্র। (ডান দিকে) শরীরচর্চার ফাঁকে কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে তুষার শীল।

সামনেই মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ হবে। পড়ুয়াদের ফল কী হবে তা নিয়ে সমান ভাবে চিন্তিত অভিভাবকেরা। তবে সংখ্যার দিক থেকে কম হলেও সমান ভাবে চিন্তায় রয়েছে আরও এক শ্রেণির পরীক্ষার্থী। তাঁরা বলতে এখানে ভোটের ময়দানে লড়া রাজনৈতিক দলের প্রার্থীদের কথা বলা হচ্ছে।

Advertisement

পরিস্থিতি আলাদা হলেও পরীক্ষা তো পরীক্ষাই। যতই চেষ্টা করুন না কেন, টেনশন যেন পিছু ছাড়তে চাইছে না তুষার শীলদের।

শুধু প্রার্থী নান, টেনশনে রয়েছেন শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে নীচু স্তরের কর্মীরাও। তাঁদের টেনশন টা কেমন বা টেনশন দূর করতে কী করছেন? খোঁজ নিতে গিয়ে হাওড়ার জয়পুরের ঝিকিরায় একটি নির্মীয়মাণ বাড়ির দোতলায় সকাল সাড়ে ৮টা নাগাদ গিয়ে দেখা মিলল আমতা কেন্দ্রের তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী তুষার শীলকে।

Advertisement

সাত সকালেই নানা আবদার নিয়ে হাজির হয়েছেন দলের কর্মীরাও। এ দিকে যোগব্যায়ামে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তূষারবাবু। ব্যায়ামবীর এই প্রার্থীর প্রতিদিন সকালে যোগব্যায়াম করার অভ্যাস। এর জন্য সময় লাগে অন্তত আধ ঘণ্টা। কিন্তু কর্মীরা ধৈর্য ধরতে নারাজ। ফলে যোগব্যায়াম করতে করতেই তিনি শুনতে লাগলেন কর্মীদের নানা কথা। ঘোড়াবেড়িয়া-চিৎনান পঞ্চায়েত থেকে এসেছেন দলীয় কর্মী সচ্চিদানন্দ দাস। ‘‘আমরাই ওখানে লিড দেব’’— বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন তিনি। তৃপ্তির হাসি তুষারবাবুর মুখেও। ভুজঙ্গাসন করতে করতেই সচ্চিদানন্দবাবুকে বললেন, ‘‘সিপিএম-কংগ্রেসের তৈরি করা কোনও প্ররোচনার ফাঁদে পা দেবেন না। এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুন।’’ এরই মধ্যে শীর্যাসন করার জন্য মাথাটি মাটিতে রেখে দু’টি পা যেই উপরে তুলেছেন ফোন এল কূশবেড়িয়া থেকে। আগামী রবিবার রক্তদান শিবির। তাতে প্রার্থীকে হাজির হতেই হবে। ফোনটি ধরলেন দলীয় এক কর্মী। কিন্তু অপরপ্রান্ত নাছোড়। প্রায় দেড় মিনিট পরে ধীরে ধীরে পা দু’টি নামিয়ে নিলেন তিনি। ফোন ধরলেন। তবে রক্তদান শিবিরে হাজির হওয়ার দাবি ফিরিয়ে দিলেন তিনি। তবে এই প্রত্যাখানের মধ্যে ফুটে উঠল যথেষ্ট বিনয়, যা তিনি রপ্ত করেছেন এই স্বল্প কয়েকদিনের রাজনৈতিক কাজকর্মের মধ্যে থেকে। ফোনে অপর প্রান্তকে বললেন, ‘‘প্রদীপবাবু, আগামী রবিবার ভাণ্ডারহাটিতে আমার বাড়ির চেম্বারে যেতেই হবে। নির্বাচনের জন্য ওখানে অনেকদিন ফাঁক পড়ে গিয়েছে। খুব খারাপ লাগছে আপনার রক্তদান শিবিরে হাজির থাকতে না পেরে।’’

তুষারবাবু কলকাতার পাইকপাড়ার বাসিন্দা হলেও তাঁর আদি বাড়ি হুগলির ভাণ্ডারহাটিতে। সেখানে মাসে দু’বার যোগ ব্যায়ামভিত্তিক চিকিৎসাকেন্দ্র চলে। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ফলে গত একমাস ধরে চেম্বারের দফারফা হয়ে গিয়েছে। ফোন রেখে তুষারবাবু বললেন, ‘‘রবিবার চেম্বারে যেতেই হবে। ফের এখানে ফিরে আসব।’’ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই কলকাতার পাট সাময়িকভাবে চুকিয়ে ঝিকিরায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে অস্থায়ী আবাস তৈরি করেছেন তিনি। রান্না-খাওয়া সবই এখানে। দলীয় কর্মীদের ভিড়ে সকাল থেকেই এই বাড়ি জমজমাট। কোন বুথে কত ভোটে তিনি লিড পাবেন সেই নিত্যনতুন খতিয়ান নিয়ে যেমন দলীয় কর্মীরা আসছেন, আবার অনেকে আসছেন যোগব্যায়াম শেখার আর্জি জানিয়ে। সেগুলি মন দিয়ে শুনছেন তিনি। মাঝে মাঝে যাচ্ছেন উলুবেড়িয়ায় একটি বেসরকারি কলেজে। যেখানে রাখা আছে ইভিএম বাক্স। ‘দেখে আসছি পুলিশ ঠিকমতো সেগুলি পাহারা দিচ্ছে না কি’— উদ্বেগের সঙ্গে বললেন তিনি। এর মধ্যে দেখা করে এসেছেন দিদির (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) সঙ্গে। কী বললেন তিনি? ‘‘দিদি বললেন, আমতা ছেড়ে চলে এলে কেন? নির্বাচনের পরে কত গোলমাল হতে পারে জান? যাও এলাকায় গিয়ে মাটি কামড়ে পড়ে থাকো গিয়ে। দিদির কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করছি। মাঝে মাত্র একবার কলকাতায় গিয়েছি। তার পর থেকে এখানেই আছি এখানকার মানুষের সঙ্গে’’, বললেন তূষারবাবু।

একই ভাবে নিজের মতো করে কাজে ডুবে আছেন আমতার বিদায়ী কংগ্রেস বিধায়ক তথা এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী অসিতবরণ মিত্র। এলাকায় তিনি অবশ্য পরিচিত অসিত মিত্র নামে। ‘‘ভোট শেষ হয়েছে তো কী? ভোট মিটে গেলেও মানুষের সমস্যা মেটাতেই দিন কাবার হয়ে যাচ্ছে।’’ বৈশাখের ঠাঠা রোদে জয়পুর থানায় আসার পথে বক্তৃতা দেওয়ার ঢঙে একথা বলে উঠলেন অসিতবাবু। কিন্তু থানায় এসেছিলেন কেন? নির্বাচনের দিনে জয়পুরে বোমা বিস্ফোরণে তিন তৃণমূল কর্মী আহত হন। তৃণমূলের পক্ষ থেকে সিপিএমের ৩৮ জন কর্মী-সমর্থকের বিরুদ্ধে এফআইআর করা হয়েছে। তাঁরা আগাম জামিন পেয়েছেন। পুলিশ যাতে আর তাঁদের গ্রেফতার না করে সেকথা জানাতেই তাঁর থানায় আসা। তাঁর দাবি, ‘‘মিথ্যা মামলায় মানুষগুলিকে ফাঁসানো হয়েছে।’’

তুষারবাবুর মতোই দেউলগ্রামে অসিতবাবুর ৩০০ বর্গফুটের ছোট্ট বাড়ি সকাল থেকেই জমে ওঠে কর্মী-সমর্থকদের ভিড়ে। এক সময়ে আসতেন শুধু কংগ্রেস কর্মীরা। এখন জোট হওয়ায় আসছেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরাও। অসিতবাবু বললেন, ‘‘ভোটের কয়েকটা দিন খুব খাটুনি গিয়েছে। ভেবেছিলাম একটু বিশ্রাম পাব। কিন্তু কর্মীদের সমস্যা মেটাতেই ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে।’’

তবে রাজনীতি করার মধ্যেও ফাঁক পেলেই আইপিএল ম্যাচ দেখতে ছাড়ছেন না। সুযোগ পেলে আবার কোনও কোনও খেলায় অংশ নেওয়ারও লোভ ছাড়তে পারেন না। যেমন এ দিন জয়পুর থানার সামনে স্ট্যান্ডে বোর্ড রেখে ক্যারম খেলছিলেন সাদা পোশাকের পুলিশ কর্মীরা। থানা থেকে বেরিয়ে ওই পুলিশকর্মীদের তিনি বললেন, ‘‘একটা দান খেলব ভাই?’’ বলেই স্ট্রাইকার বেছে নিলেন তিনি। ডানহাতের তর্জনী দিয়ে ধাক্কা মারলেন স্ট্রাইকারে। সেটি গিয়ে ধাক্কা মারল গুটিতে। তা পড়ল বোর্ডের উল্টোদিকের কোনার গর্তে। পুলিশ কর্মীরা হাততালি দিয়ে উঠলেন। নির্বাচনের ফল নিয়ে কোনও টেনশন করছেন? ফের একবার স্ট্রাইকার টেনে নিয়ে লক্ষ্য স্থির করতে করতে অসিতবাবু বলে উঠলেন, ‘‘একদম না।’’ — নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন