মৃত পশু নিয়ে দিনযাপন কি অবসাদেই

বালির কৈলাস ব্যানার্জি লেনে দোতলা বাড়িতে দিনের পর দিন মরা কুকুর-বিড়ালের দেহ আগলে রাখা দম্পতি রণেশ বাগচী ও তাঁর স্ত্রী শ্বেতাদেবীর এই পরিবর্তন চোখে পড়েছিল প্রতিবেশীদেরও। তাঁদের অবাক লাগে, এক সময় যাঁদের বাড়ি সব সময়ে পরিপাটি থাকত এখন সেখানেই কি না পচা মৃতদেহ জমে!

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ০২:১৪
Share:

রণেশ বাগচী। নিজস্ব চিত্র

এক সময় তিনি দামি সুগন্ধী ছাড়া ব্যবহার করতেন না। এক জামা দু’দিন পরা তো দূরের কথা, দু’বেলা পরতেন না। বরং পরিপাটি জামাকাপড় পরে সস্ত্রীক উপস্থিত হতেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বিচারক হিসেবে। কিন্তু শেষ কয়েক বছরে সব কেমন যেন বদলে গিয়েছে!

Advertisement

বালির কৈলাস ব্যানার্জি লেনে দোতলা বাড়িতে দিনের পর দিন মরা কুকুর-বিড়ালের দেহ আগলে রাখা দম্পতি রণেশ বাগচী ও তাঁর স্ত্রী শ্বেতাদেবীর এই পরিবর্তন চোখে পড়েছিল প্রতিবেশীদেরও। তাঁদের অবাক লাগে, এক সময় যাঁদের বাড়ি সব সময়ে পরিপাটি থাকত এখন সেখানেই কি না পচা মৃতদেহ জমে!

একমুখ সাদা দাড়ি, মলিন পাঞ্জাবি, ছেঁড়া নোংরা পাজামা পরে মাঝেমধ্যে বাড়ি থেকে বেরোন রণেশবাবু। এক সময় এলাকার বেকার যুবকদের চাকরি দেওয়া, কারও বিয়ে, অসুস্থতায় আর্থিক সহযোগিতা করা ওই মানুষটিই এখন কারও সঙ্গে কথা বলেন না। আর ফিশ ফ্রাই, মাংস রান্না করে খাওয়ানো শ্বেতাদেবী তো শেষ কত বছর আগে বেরিয়েছেন তা-ও এখন মনে করে বলতে হয় প্রতিবেশী তমালিকা গোস্বামী ও মিতালী চট্টোপাধ্যায়দের।

Advertisement

তাঁরাই জানান, সাত-আট বছর ধরে কুকুর-বিড়ালকে নিয়েই চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেদের জগৎ তৈরি করে নিয়েছেন রণেশবাবুরা। এমন পরিবর্তন বুঝতে পারেন তিনি নিজেও। কিন্তু কেন? শনিবার বাড়ির সামনে বসে রণেশবাবু বলেন, ‘‘আমার বয়সী লোকগুলো সব মরে গিয়েছে। তখনকার সমাজ, জগতটাও কেমন যেন সব হারিয়ে গেল। কবে থেকে যে এমন সরে এলাম মনেও পরে না।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পোষ্যগুলিই তো আমাদের অবলম্বন। ওঁদের নিয়ে থেকে মনে খুব শান্তি পাই।’’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা অবশ্য রণেশবাবুদের এই অবস্থার মূল কারণ মনে করছেন, তাঁদের অবসাদ ও নিঃসঙ্গতাকেই। যেখানে সারা দিনের কর্মব্যস্ততা থেকে অবসরের পরে তৈরি হয় এই অবসাদ। মনোরোগ চিকিৎসক প্রদীপ সাহা জানালেন, এই অবসাদ থেকেই প্রবল শূন্যতার অনুভূতি তৈরি হয়। ওই অনুভূতি থেকে নিজেকে সমাজের সব থেকে বিফল মানুষ হিসেবে ভাবতে শুরু করেছিলেন। যদিও তিনি বাস্তবে তা নন। প্রদীপবাবু বলেন, ‘‘ওই ভাবনা ওঁকে মনে করতে দেয় না নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার কথা। আর শূন্যতার অনুভূতিতে তৈরি হওয়া জগতের কষ্টকে চাপা দিতেই তিনি যে পোষ্যদের নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন, তাদের মৃত্যুকেও মেনে নিতে
পারেন না।’’

এ দিনও রণেশবাবু বলেন, ‘‘আমি কি পাগল, যে মরা কুকুর রেখে দেব। ওঁরা তো সব বাসন নিয়ে গিয়েছে।’’ চাকরি জীবনেই বাড়িতে দু’টি কুকুর পুষতেন রণেশবাবু। নাম ছিল ভেল্টু ও কাল্টু। প্রতিবেশীরা জানান, রুপোর চেন পরানো থাকতো পোষ্যদের গলায়। এখন বাড়িতে রয়েছে গাপ্পা, গজো, গদা, হলদি, ধসা-সহ বিভিন্ন নামের সাতটি কুকুর। চাকরি জীবনের জমানো টাকাও প্রায় শেষ। রণেশবাবুই জানালেন নিজেদের খাবার না জুটলেও ‘ছেলে-মেয়ে’র খাবার রোজ দেন। স্থানীয় ক্লাব বালক সমিতির সদস্যেরা জানান, ওঁনাদের চিকিৎসা দরকার। এলাকার সকলে পাশে আছেন।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাংবাদিকতায় এম এ এবং রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেন্টিং ও নাটকে ডিপ্লোমা করা রণেশবাবু এক সময় চুটিয়ে নাটক করতেন। শ্বেতাদেবীও নৃত্যে এম এ পাশ করে কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় নাচ শেখাতেন। পুরনো কথা বলতেই, সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ বললেন, ‘‘কত বাচ্চা আমার বাড়িতে আসতো, রবীন্দ্রজয়ন্তী হত। সব কেমন হারিয়ে গেল। আর মনে করতে ভাল লাগে না।’’

কথা শেষ করেই পা বাড়ালেন বাড়ির দিকে। দোতলার জানলা দিয়ে উঁকি মারছে ধূসর রঙের কুকুর। তার দিকে হাত তুলে রণেশবাবু আক্ষেপ, ‘এই তো আমার ধসা। তোরা বেইমান না।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন