আশায়: কাজে ব্যস্ত তালা কারখানার কর্মীরা। ছবি: সুব্রত জানা
এখানকার তালার কদর গিয়েছে অনেক আগেই। টিকে থাকতে অনেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দিকে ঝুঁকেছেন। তাতেও সমস্যা মিটল কই? জগৎবল্লভপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার এক সময়ের তালা কারিগর এবং কারখানা মালিকেরা এখন রাজ্য সরকারের দিকেই তাকিয়ে।
জগৎবল্লভপুরের বড়গাছিয়া, হাঁটাল, সাদাতপুর, মানসিংহপুর, পাতিহাল বড়গাছিয়া প্রভৃতি এলাকায় তালা শিল্প ছিল ঘরে ঘরে। দক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি তালা চলে যেত দেশের নানা প্রান্তে। ১৯৫২ সালে বড়গাছিয়ায় রাজ্য সরকার ‘সেন্ট্রাল লক ফ্যাক্টরি’ তৈরি করে। এই কারখানায় তালা তৈরি হতো। স্থানীয় তালা কারখানাগুলিতে যন্ত্রাংশের জোগানও যেত ওই কারখানা থেকে। কিন্তু ধীরে ধীরে আলিগড়ের তালা বাজার ধরে নেয়। চাহিদার অভাবে ১৯৮০ সালের গোড়ায় বন্ধ হয় ‘সেন্ট্রাল লক ফ্যাক্টরি’। বন্ধ হয়ে যায় অধিকাংশ ছোট তালা কারখানা।
সেখানকার কর্মী-শ্রমিকেরা ঝোঁকেন ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের দিকে। হাওড়ার বেলিলিয়াস লেনের মতো জগৎবল্লভপুরেও বহু ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা গড়ে ওঠে। অন্তত দশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়। যে ক’টি তালা কারখানা তারপরেও চলছিল, তাদের কাছে বড় ধাক্কাটা আসে বছর দুয়েক আগে দাশনগরে রাজ্য সরকারের পরিচালিত ‘সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। তারা জগৎবল্লভপুরের ছোট কারখানার তালা কিনে রাজ্যের বিভিন্ন সংশোধনাগার, সরকারি হাসপাতাল-সহ নানা জায়গায় পাঠাত। কিন্তু সংস্থাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তালা কারখানাগুলির কর্মীরা।
কেন্দ্র সরকারের আর্থিক সহায়তায় ‘বড়গাছিয়া মেটাল ক্লাস্টার’ নামে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ক্লাস্টার গড়ে তোলার চেষ্টা করেন কারখানা-মালিকেরা। কেন্দ্র সরকার পরিকল্পনা মঞ্জুর করে পাঁচ কোটি টাকা দিতেও রাজি হয়। যাতে সেখানে ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ (সুযোগ-সুবিধা কেন্দ্র) গড়া হয়। ‘সেন্ট্রাল লক ফ্যাক্টরি’র পতিত জমিতে ওই ক্লাস্টার তৈরির কথা থাকলেও জমি-জটে তা আটকে যায়। বছর দুয়েক আগে কারখানা-মালিকেরা ক্লাস্টারের নামে পাশেই পাঁচ কাঠা জমি কেনেন। তাঁদের দাবি, তখন রাজ্য সরকার আশ্বাস দিয়েছিল। তারা দু’কোটি টাকা খরচ করে ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ বানিয়ে দেবে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। দিন ফেরেনি টিম টিম করে চলতে থাকা খানদশেক তালা কারখানারও।
কিছু তালা কারখানার মালিকেরা জানান, ‘সেন্ট্রাল ইঞ্জিনিয়ারিং অর্গানাইজেশন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সরকারি বরাতের জন্য তাঁদের সরাসরি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। তাতে বড় সংস্থাগুলির সঙ্গে এঁটে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না। সবচেয়ে পুরনো কারখানার মালিক বিশ্বনাথ কর বলেন, ‘‘আমাদের মতো কিছু তালা কারখানা গুণমান বজায় রেখেছি। আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে তালা তৈরি করছি। তাই মোটামুটি ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পেরেছি। কিন্তু এ ভাবে সকলের পক্ষে চলা সম্ভব নয়।’’ বিশ্বনাথবাবুর ছেলে তুষার বলেন, ‘‘সরকারি বরাতের জন্য রাজ্যের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প দফতরে যোগাযোগ করেও লাভ হচ্ছে না।’’ ‘বড়গাছিয়া মেটাল ক্লাস্টার অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক স্বপন মণ্ডলেরও ক্ষোভ, ‘‘জিএসটি-র চাপে নাভিশ্বাস উঠছে। উৎপাদিত পণ্যের দাম বাড়ছে। কমন ফেসিলিটি সেন্টার তৈরি হলে সুবিধা হতো। অনেক কম খরচে কাজ করানো যেত। সেটাও তো এখনও হল না।’’
কী বলছে রাজ্য সরকার?
তালা শিল্প নিয়ে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প দফতরের এক কর্তা জানান, নতুন নিয়মে ছোট কারখানাগুলি থেকে উৎপাদিত দ্রব্য সরকারের কাছে জোগান দিতে হলে নির্দিষ্ট অ্যাপ-এ নাম নিবন্ধীকরণ করতে হয়। তুষারের অভিযোগ, ওই অ্যাপ-এ নাম নিবন্ধীকরণ করানোর পরেও উত্তর পাননি। অবশ্য ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ নিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন ওই কর্তা। তিনি বলেন, ‘‘দ্রুত কেন্দ্র তৈরির জন্য টাকা দেওয়া হবে।’’
ওই আশ্বাসই এখন ভরসা বড়গাছিয়ার।