বন্ধ হয়ে পড়ে পুলিশ কিয়স্ক।
‘মৃত্যুফাঁদ’ দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবনতি হচ্ছে দিনকে দিন।
লরি-ট্রাকের ‘লেন’ ভাঙার বিরাম নেই। গরু-বাছুর চরছেই। ধীর গতির সাইকেল-মোটরবাইক বা মোটরভ্যান চলাচলও বন্ধ হয়নি। এ সবের জন্য দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে যে কতটা অরক্ষিত, তা গত কয়েক বছরে একের পর এক দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে প্রশাসনের কর্তাদের। কিন্তু তার পরেও তাঁদের হুঁশ ফেরেনি। নিরাপত্তা বাড়ানোর কোনও ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, উল্টে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ওই জাতীয় সড়কের ধারের পুলিশ-কিয়স্কও। কয়েক বছর আগে গাড়ির উপরে নজরদারি এবং যান নিয়ন্ত্রণের জন্য যা তৈরি হয়েছিল।
তাই এখন কার্যত অরক্ষিত ওই জাতীয় সড়ক। থামছে না দুর্ঘটনাও। গত সোমবারই গুড়াপের মাজিনানে বিহারের পুণ্যার্থী বোঝাই একটি বাস ‘ডিভাইডারে’ ধাক্কা মেরে উল্টে যাওয়ায় মৃত্যু হয় দু’জনের। আহত হন বেশ কয়েক জন। তার আগে, গত অগস্টেই ডানকুনিতে ‘ডিভাইডারে’ ধাক্কা মেরে একটি ট্রাক টোলপ্লাজায় ঢুকে যায়। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।
মোটা টাকা ‘টোল’ দিয়ে ওই সড়ক ব্যবহার করতে হয় যানবাহনকে। যে সড়কের একটি বড় অংশই পড়ছে হুগলি জেলায়। কিন্তু কেন সড়কে নিরাপত্তার দিকটি এখনও গুরুত্ব পেল না?
হুগলির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কোটেশ্বর রাওয়ের দাবি, পুলিশ যথাযথ নজরদারি চালায়। জাতীয় সড়কের প্রতিটি থানা এলাকায় দিনে নজরদারির পাশাপাশি মূলত রাতে পুলিশের মোবাইল ভ্যান থাকে। তবে, পুলিশ-কিয়স্ক বন্ধ হওয়া নিয়ে ওই পুলিশ কর্তা বলেন, ‘‘ডানকুনিতে পুলিশের সংখ্যায় কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে, যান নিয়ন্ত্রণে ডানকুনিতে কিন্তু পুলিশ আছে। আর সিঙ্গুরে পর্যাপ্ত না হলেও কিয়স্ক মোটামুটি কাজ করছে।’’
জায়গার গুরুত্বের নিরিখে ডানকুনি, সিঙ্গুর এবং বর্ধমানের জামালপুর-সহ বিভিন্ন জায়গায় দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপরে পুলিশ-কিয়স্ক তৈরি হয়েছিল কয়েক বছর আগে। পরিবহণমন্ত্রী ডানকুনিতে গিয়ে ঘটা করে উদ্বোধনও করেছিলেন। প্রাথমিক ভাবে সেগুলি নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু সময় যতই গড়িয়েছে, সেগুলিতে কাজের কাজ ঠিক কতটা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যাত্রীরা।
বর্তমানে ডানকুনির পুলিশ-কিয়স্ক বন্ধ। ব্যবহার না হওয়ায় তা অযন্তে পড়ে রয়েছে। এখন আর পুলিশকর্মীদের বসার অবস্থায় নেই। অথচ, গাড়ির চাপ এবং গুরুত্বের দিক থেকে ডানকুনি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। এখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কড়া হওয়া অত্যন্ত জরুরি বলেই মনে করেন অধিকাংশ গাড়ি-চালক। ডানকুনি মোড় থেকে দিল্লি রোড এবং দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ডানকুনির মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকার পুলিশ-কিয়স্কই বন্ধ হয়ে গিয়েছে দীর্ঘদিন আগে।
ডানকুনির পরই দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর সিঙ্গুরের আলুর মোড়ের গুরুত্ব রয়েছে যথেষ্ট। এখান থেকেই তারকেশ্বর হয়ে আরামবাগ কর্ড শাখার রেল লাইন। কামারকুণ্ডু স্টেশন। আলুর মোড়ের অদূরেই রাজ্যের অন্যতম বড় রাসায়নিক কারখানাও রয়েছে। সব দিক বিবেচনা করে এই জায়গাতেও একটি পুলিশ-কিয়স্ক তৈরি করা হয়েছিল। সেটির ঝাঁপ কোনও রকমে খোলা থাকলেও কাজের কাজ কিছুই হয় না বলে অভিযোগ। অথচ, এই পুরো এলাকাটিই জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের ম্যাপে ‘দুর্ঘটনাপ্রবণ’ হিসেবেই চিহ্নিত।
রাস্তার উপর এ ভাবেই ট্রাক থেকে গাড়ি খালাস চলে।
দেখার কেউ নেই। ফলে, নিয়ম-বিরুদ্ধ ভাবে সড়কের ধারে ট্রেলার ও পণ্যবাহী ট্রাক দাঁড় করিয়ে মালপত্রও নামানো হচ্ছে অবাধে। টহলদার পুলিশ সে সব দেখেও দেখে না বলে অভিযোগ রয়েছে যাত্রীদের। এই কারণেও যে দুর্ঘটনা ঘটছে, সে কথা মানছেন জেলা পুলিশেরই একাংশ। গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে আলোর দাবিও রয়েছে যাত্রীদের। কিন্তু সেই দাবি এখনও পূরণ হয়নি। সোমবারের গুড়াপের দুর্ঘটনারই তদন্তে নেমে পুলিশ মনে করছে, ওই মোড়ে আলোর ব্যবস্থা না থাকায় সম্ভবত বিহারের বাসটির চালক ‘ডিভাইডার’টি ঠাহর করতে পারেননি।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে যখন দুর্ঘটনা এমন লাগামছাড়া, তখন এ রাজ্যেরই ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক বা মুম্বই রোডে দুর্ঘটনা আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। ওই সড়কের ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প অধিকর্তা রমাকান্ত কুশওয়াহা বলেন, ‘‘মুম্বই রোডে সমস্ত বেআইনি ‘কাট’ (যেখান দিয়ে গাড়ি অন্য লেনে ঢুকে পড়ে) বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ট্রাক যাতে নির্দিষ্ট লেন ছাড়া না দাঁড়ায় সেটি পুলিশকে নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে আলো লাগানোর কাজ চলছে। ফলে, সব মিলিয়ে দুর্ঘটনায় অনেকটাই লাগাম পরানো গিয়েছে।’’
এই ব্যবস্থা দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে কবে হবে, সেই প্রশ্নই এখন ঘুরপাক খাচ্ছে নিত্যযাত্রীদের মনে।
দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে ছবি তুলেছেন দীপঙ্কর দে।