হঠাৎ বদলে গিয়েছে চেনা ছন্দ

ভিত থেকেই যেন আমূল নড়ে গিয়েছে সবটা।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

উত্তরপাড়া শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৮ ০৩:১৮
Share:

দোকানে মায়ের সঙ্গে স্বর্ণালী। ছবি: দীপঙ্কর দে

জিটি রোডের ধারে ছোট্ট দোকানের ভিতর ম্যানিকুইন সাজাচ্ছে বছর একুশের মেয়েটি। ‘‘ফুটপাথের রেলিংয়ে পুতুলগুলো সাজালে পথচলতি মানুষের চোখে পড়বে,’’ নির্বিকার গলায় বলে দেয় মেয়ে। ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ অক্টোবর— মাত্র ২৩ দিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছেন স্বর্ণালী। বদলে গিয়েছে জীবনের চেনা রুটিন, বাড়ির চেনা ছন্দ।

Advertisement

ভিত থেকেই যেন আমূল নড়ে গিয়েছে সবটা।

আর তাঁর বাড়িতে ঘুরে বেড়ায় দেড় বছরের আর এক মেয়ে। ঘরময় ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়ায় ‘দাদা’কে। ঠাকুরদার ছবি এনে দিলে ছোট্ট দু’হাতে আঁকড়ে ধরে মুখে নেয় বোতল। দুধ, লেবুর রস খেয়ে ফেলতে সময় লাগে না আর।

Advertisement

গত ২০ সেপ্টেম্বর উত্তরপাড়ার সরোজ মুখার্জি রোডে পুরনো একটি বাড়ি ভাঙার সময় চাঙড় খসে মৃত্যু হয় সুকুমার দাসের। তাঁরই মেয়ে স্বর্ণালী। দেড় বছরের নাতনি অহনাকে অবশ্য সে সময় দেখা যায়নি তেমন। এখন তাঁদের ছোট্ট বাড়িটায় গেলে শোনা যায় সেই আদুরে গলা। ছবি জড়িয়ে ধরে খুঁজে বেড়ায় ‘দাদা’কে।

মেয়ে অহনাকে কোলে নিয়ে সুকুমারবাবুর ছেলে পার্থ দেখান নামী সংস্থার একটি সাউন্ড সিস্টেম। ‘‘বাবা গান শুনতে ভাল বাসত। রাতে দোকান বন্ধ করে এসে গান চালাত। চাকরি পেয়ে আমিই কিনে দিয়েছিলাম ওটা, কিস্তিতে। এ মাসেই শেষ হল ইএমআই। অথচ, বাবাই আর নেই।’’

খোঁজ: ভাইঝি অহনার কোল বাবার ছবি। ছবি: দীপঙ্কর দে

এ বছর তাই মহালয়ার সুর ওঠেনি দাস বাড়িতে। উত্তরপাড়া জামরুলতলা গলির আর পাঁচটা তরুণী যখন ঘুরে বেড়াচ্ছেন পুজোর হুল্লোড়ে। স্বর্ণালী তখন খুলে বসেছেন বাবার দোকান। সঙ্গী মা, মামা। কলেজ যাচ্ছেন না? প্রশ্নের উত্তরে তাঁর জবাব, ‘‘প্রতিটি সিমেস্টারের খরচ জোগাব কোত্থেকে, সেটাই এখন ভাবছি। পুজোর সময় সকলেই প্রিয়জনের জন্য কিছু কিনতে চায়। তাই এখন দোকানটা নিয়েই ভাবছি।’’

বাবার দোকান, বড় আদরে সামলাচ্ছেন স্বর্ণালী। ছোট ছোট প্লাস্টিকের পুতুলের গায়ে যত্ন করে পরিয়ে দেন পোশাক, সেগুলো ঝুলিয়ে দেন একেবার রেলিংয়ের ধার ঘেঁষে। সামান্য সম্ভার সম্বল করে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা।

স্বর্ণালী বলেন, ‘‘এই সামান্য রোজগারে বাবা যে কী করে আমাকে, দাদাকে বড় করেছে জানি না। মা-ই বা কী করে সামতাল, বুঝতে পারি না। এখন দাদা আর আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তবু ঘুরে তো দাঁড়াতেই হবে।’’

শক্ত মেয়েটা অবশ্য ভেঙে পড়েন পুজোর কথায়। গত বছরও তো কত আলো ছিল, কত খুশি ছিল এই আকাশেই! এ বছর মেঘে ভারী আকাশটা যেন ঠিক স্বর্ণালীর মতো। ‘‘প্রতি বার বিকেলের মধ্যে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বাড়ি ফিরে আসতাম। বাবা দোকান বন্ধ করে ফিরলে মা-বাবার সঙ্গে ঠাকুর দেখতে বেরতাম রাতে। রোজ।

অনেক সময় একই ঠাকুর দেখতাম...’’ বুজে আসে স্বর্ণালীর গলা। ঝুপঝুপে বৃষ্টি ভিজিয়ে দিয়ে যায় দোকানের উপরে লাগানো পলিথিন। মেয়ে ছুটে যায় জামাগুলোর দিকে— জলের ছিটে না লাগে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন