বেলাগাম খরচ প্রচারে, চুপ প্রশাসন

কোথাও বিশাল ফ্লেক্সে প্রার্থীদের হাতজোড় করা হাসিহাসি মুখ। কোথাও দলনেত্রীর মস্ত কাটআউট। তাতেও রেহাই নেই। দিনের আলোয় না হয় চোখে পড়ল ফ্লেক্সের প্রচার, রাতে যদি না পড়ে? তাই রাতের জন্যও এখন পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। ফ্লেক্সের চারপাশে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে এলইডি আলো। তাতেই ঝলমল করছে প্রার্থীর নাম, দলীয় প্রতীক। বিদ্যুতের ব্যবস্থা হচ্ছে কোথা থেকে, সে প্রশ্ন আর কে করছে ভোটের বাজারে।

Advertisement

গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায়

চুঁচুড়া শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:২০
Share:

কোথাও বিশাল ফ্লেক্সে প্রার্থীদের হাতজোড় করা হাসিহাসি মুখ। কোথাও দলনেত্রীর মস্ত কাটআউট। তাতেও রেহাই নেই। দিনের আলোয় না হয় চোখে পড়ল ফ্লেক্সের প্রচার, রাতে যদি না পড়ে? তাই রাতের জন্যও এখন পাকা ব্যবস্থা করে ফেলেছেন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। ফ্লেক্সের চারপাশে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে এলইডি আলো। তাতেই ঝলমল করছে প্রার্থীর নাম, দলীয় প্রতীক। বিদ্যুতের ব্যবস্থা হচ্ছে কোথা থেকে, সে প্রশ্ন আর কে করছে ভোটের বাজারে।

Advertisement

গঙ্গাপারের জেলা হুগলিতে উত্তরপাড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া— ১০টি পুর এলাকার সর্বত্রই কমবেশি একই প্রচারের ছবি। গ্রামঘেঁষা পুরসভা ডানকুনিতেও প্রচারের জেল্লা কিছুমাত্র কম নয়। প্রচারে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার চেষ্টা জারি রয়েছে প্রার্থীদের মধ্যে। জেলার কোনও কোনও অংশে নির্দল প্রার্থীরাও প্রচারের দৌড়ে পিছিয়ে নেই। ফ্লেক্স-কাট আউট-পতাকা লাগানোর এই ইঁদুরদৌড় যেন দিন দিন বাড়ছে। যার যত ফ্লেক্স, তার তত ভোট, এমন কোনও অলিখিত নিয়মের তাড়নায় ছুটছেন প্রার্থীরা।

কিন্তু খরচ জোগাচ্ছে কে?

Advertisement

প্রার্থীরা প্রচারে বে-লাগাম খরচ করতে পারেন না, বলছে নির্বাচন কমিশনের বিধি। ওই বিধি অনুয়ায়ী, প্রত্যেক প্রার্থী ৩০ হাজার টাকার বেশি খরচ করতে পারবেন না। ভোটার পিছু প্রার্থীরা আদপে খরচ করতে পারবেন সাকুল্যে পাঁচ টাকা। যে ক্ষেত্রে কোনও ওয়ার্ডে ১০ হাজারের বেশি ভোটার, সে ক্ষেত্রে একই অঙ্ক। সেই নিয়মের কোথাও কোনও ব্যতিক্রম হলে বিষয়টি পর্যবেক্ষকদের দেখার কথা। অথচ চোখের সামনে এক একটা পুরসভায় লাগামহীন খরচ দেখেও, জেলার কোনও পর্যবেক্ষক কোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে একটিও অভিযোগ দায়ের করেননি।

বিরোধীরা বলছেন, বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে? শাসক দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধেই তো মাত্রাছাড়া খরচের অভিযোগ আনতে হবে সব চাইতে বেশি। খরচের অঙ্ক নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলি আকচাআকচি করলেও, বিরোধীদের অভিযোগ কিন্তু মিথ্যা নয় বলেই ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। প্রচারের বাহুল্যে শ্রীরামপুর, উত্তরপাড়া, বাঁশবেড়িয়া, চুঁচুড়া, চন্দননগর, সর্বত্রই কমবেশি একই ছবি।

কোনটার কত দাম

• টুপি— ৮ টাকা থেকে ২৫ টাকা।

• উত্তরীয়— ১৫-২০ টাকা।

• বড় ফ্লেক্স— হাজার টাকার উপর।

• এলইডি বোর্ড— ৩-৪ হাজার টাকা।

• ভিনাইল বোর্ড— ২ হাজার টাকা।

ফ্লেক্সের জেল্লা যতই বাড়ছে, ততই প্রশ্ন উঠছে, প্রার্থীরা খরচের টাকা জোগাড় করছেন কী করে? সে ক্ষেত্রেও শাসকদলের বিরুদ্ধেই অনৈতিকতার অভিযোগের আঙুল তুলতে শুরু করেছেন বিরোধীরা। সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘কমিশন তার দায়িত্বই পালন করছে না। পর্যবেক্ষকদের প্রতিটি বিষয়টি দেখা দায়িত্ব। নিয়ম অনুয়ায়ী প্রার্থী পিছু নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা খরচের নিয়ম রয়েছে। ভোটার পিছু প্রচারে খরচ বেধে দেওয়া আছে আইনে। কিন্তু মানা হচ্ছে কই! লোকসভা, বিধানসভা নির্বাচনের সময় দেখেছি পর্যবেক্ষকরা ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলেন। কিন্তু পুর নিবার্চনে কমিশন আছে বলেই মনে হচ্ছে না।’’

এখন দেখার, রাজনৈতিক দলগুলি তাঁদের প্রার্থীদের জন্য কত টাকা বরাদ্দ করছেন। শাসকদল তৃণমূল এবার প্রার্থী পিছু ১০ হাজার টাকা করে দিয়েছে। সূত্রের খবর, সিপিএম প্রার্থীপিছু নগদ টাকা আদৌ দেয়নি। মোট ২০ হাজার টাকার কুপন দেওয়া হয়েছে প্রার্থীদের। সেই কুপনে টাকার অঙ্ক ১০, ৫০, ১০০ আর ৫০০ টাকা। প্রার্থীরা কুপন বেচে পয়সা তুলবেন। আবার কোনও ক্ষেত্রে এলাকার জোনাল কমিটি প্রার্থীদের পোষ্টার, ফ্লেক্স আর তাঁদের পরিচয়ের হ্যান্ডবিল করে দিচ্ছে।

বিজেপি-ও সিপিএমের মতই কুপন দিয়েছে প্রার্থীদের। তা ছাড়াও প্রার্থীদের নগদ দিয়েছে পাঁচ হাজার টাকা করে। এক হাজার টাকার বেশি যাঁরা দেবেন, তাঁদেরকে অবশ্য বিজেপি-র পক্ষ থেকে বিল দেওয়া হচ্ছে। আর কংগ্রেস এ পর্যন্ত প্রার্থীদের ভোটের প্রচারে কোনও টাকাই দিয়ে উঠতে পারেনি। জেলা কংগ্রেস নেতা প্রীতম ঘোষ বলেন, ‘‘আমাদের প্রার্থীরা প্রচার করছেন নিজেদের উদ্যেগে। এখনও তাঁদের কিছু দেওয়া যায়নি। কিন্তু যে পরিমাণ টাকা রাজ্যের শাসকদল খরচ করছে, তা এককথায় অভাবনীয়। অনৈতিক এই খরচ দেখার দায় কমিশনের। কিন্তু ওঁরা চোখ বুজে।’’

চুঁচুড়ার এক সিপিএম প্রার্থী বলেন, ‘‘খোঁজ নিয়ে দেখলাম একটা ছোট তিন ফুট বাই ছয় ফুটের ফ্লক্সের দাম পড়ছে ১৭০ টাকা। বড় দশ ফুট বাই কুড়ি ফুটের ফ্লেক্সের দাম পড়ে যাচ্ছে প্রায় ১০০০ থেকে ১৪০০ টাকা। এরপর আর সাহস করিনি ফ্লেক্স লাগাতে।’’ তাঁর অভিযোগ, শহরে সর্বত্র শাসকদল দেদার বড় বড় ফ্লেক্স লাগাচ্ছে। প্রমোটাররা পিছনে না থাকলে এমন বিপুল খরচ সম্ভব নয়।

ফরওয়ার্ড ব্লকের রাজ্য নেতা নরেন চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুরভোটে শাসকদল যে মাত্রায় টাকা খরচ করছে তা লোকসভা নির্বাচনেও হয় না। কমিশন দেখছে না বলে এবার মাত্রাছাড়া খরচ হচ্ছে।’’ জেলার বিজেপি নেতা প্রণব চক্রবর্তী বলেন, ‘‘কোনও ক্ষেত্রেই পুলিশ বা অবজারভারকে অভিযোগ জানালেও তার সাপেক্ষে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তাই প্রচারের খরচে শাসকদল বেলাগাম।’’

তৃণমূলের জেলা সভাপতি তপন দাশগুপ্ত বলেন, ‘‘সব দলই প্রচার করছে, শুধু অভিযোগ উঠছে আমাদের নামে। উৎসাহী হয়ে আমাদের কর্মী-সমর্থকদের অনেকেই প্রচারে সহায়তা করছেন।’’ তাঁর কটাক্ষ, বামেরা অতীত ভুলতে বসেছেন। ‘‘এখন যাঁরা অভিযোগ করছেন, তাঁরাই এক সময়ে নির্বিচারে বিধিভঙ্গ করেছেন।’’

এ বিষয়ে একাধিক অবজার্ভারের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁরা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন