আয়ার দাপটে জেরবার আরামবাগ হাসপাতাল

স্যালাইন খুললেও দিতে হয় ৫০ টাকা

সরকারি হাসপাতালে সমস্ত রকম পরিষেবাই নিখরচায় পাওয়ার কথা রোগীদের। পরিস্থিতি এমনই যে, আশাকর্মীদের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রসূতিদের থেকেও নেওয়া হয় আয়া খরচ। অভিযোগ, লেবার রুমে হাত ধরে নিয়ে যান আয়া— সে জন্য টাকা নেন ১০০।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৮ ০৩:১৬
Share:

হাসপাতালে থাকলে রোগীকে দেখভালের কাজ করবেন আয়া। সে জন্য দিতে হবে ১৫০ টাকা। তার উপর আছে জামা-কাপড় কাচা, চুল আঁচড়ে দেওয়ার মতো নানা ‘পরিচর্যা’— সে জন্যও শ’খানেক টাকা। ছুটির সময় হাত থেকে স্যালাইনের নলও নাকি খুলে দেন আয়ারা— বিনিময় মূল্য পঞ্চাশ টাকা মাত্র। রোগীর সঙ্গে তাঁর আত্মীয় থাকলেও রেহাই নেই। গত কয়েক মাস ধরে এমনই নানা অভিযোগে জেরবার আরামবাগ মহকুমা হাসপাতাল। যদিও সে সব কথা জানেন না হাসপাতাল সুপার।

Advertisement

সরকারি হাসপাতালে সমস্ত রকম পরিষেবাই নিখরচায় পাওয়ার কথা রোগীদের। পরিস্থিতি এমনই যে, আশাকর্মীদের তত্ত্বাবধানে থাকা প্রসূতিদের থেকেও নেওয়া হয় আয়া খরচ। অভিযোগ, লেবার রুমে হাত ধরে নিয়ে যান আয়া— সে জন্য টাকা নেন ১০০। মাস খানেক আগে গোঘাটের এক প্রসূতির থেকে টাকা না পাওয়ায় ছুটির পর তাঁকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখার অভিযোগ উঠেছিল। গোঘাটের বাসিন্দা সুমতি মাজি নামে ওই মহিলা ইটভাটায় শ্রমিকের কাজ করেন। সঙ্গে থাকা আশাকর্মীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা হয় বলে অভিযোগ।

কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জননী শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম’-এর নিয়ম অনুযায়ী সরকারি হাসপাতালে কোনও প্রসূতির একটা পয়সাও খরচ হবে না। ওষুধ, চিকিৎসা, খাবার, প্রসবের জন্য বাড়ি থেকে হাসাপাতাল এবং ফিরে যাওয়ার গাড়ি— সবই বিনামূল্য। এমনকী হাসপাতালে প্রসবের জন্য সরকার কিছু টাকা দেয় প্রসূতিকে, পরবর্তী শুশ্রূষার জন্য। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক আশা কর্মী বলেছেন, ‘‘প্রসূতির যাবতীয় দেখভালের দায়িত্ব হাসপাতালের। তা হলে আয়াকে কেন পয়সা দিতে হবে? বিষয়টা নিয়ে হাসপাতাল সুপারকে একাধিকবার বলা সত্ত্বেও সুরাহা হয়নি।”

Advertisement

গোটা ঘটনাটি কার্যত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন আরামবাগ মহকুমা হাসপাতালের সুপার শিশির নস্কর। তাঁর দাবি, ‘‘খাতায় কলমে আমাদের আয়া বলে কিছু নেই। রোগীর বাড়ির লোক হিসাবে কে কখন ঢুকে কার কাছে থাকছেন তা আমাদের জানারও উপায় নেই!’’ কিন্তু কে হাসপাতালে ঢুকছে, থাকছে তার হিসাবে নেই কর্তৃপক্ষের কাছে? সুপারের জবাব, ‘‘প্রতিটি ওয়ার্ডে আমাদের নোটিস দেওয়া আছে— ‘কাউকে টাকা দেবেন না’। তারপরেও রোগীরা দিচ্ছেন কেন?”

রোগী বা তাঁদের পরিজনেরা কিন্তু বলছেন অন্য কথা। নানা অজুহাতে আয়া রাখতে বাধ্য করা হয়। অভিযোগ, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছেন কিছু নার্সও। জানা গিয়েছে, মহকুমা হাসপাতালে দীর্ঘদিন ধরে প্রায় ৬০ জন আয়া কাজ করছেন। অভিযোগ, ছুটির সময় দাবি মতো টাকা না পেলে রোগীদের জামা কাপড় কেড়ে রেখে দেন অনেকে। রাতে রোগীর বাড়ির লোক হাসপাতালে থাকলেও জোর করে রোগী দেখভালের দায়িত্ব নেন আয়ারা। পারিশ্রমিক ১৫০ টাকা প্রতিদিন। এক একজন আয়া আবার ৫-৬ জন রোগীর দেখভাল করেন একসঙ্গে।

দিন কয়েক আগেই মেল মেডিসিন ওয়ার্ড থেকে ছাড়া পেয়েছেন খানাকুলের ঘোষপুরের এক রোগী। তাঁর ছেলে ইসমাইল কাজির অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর, “আয়া রাখার জন্য সিস্টাররাও চাপ দেন। আমার বাবা বমি করে ফেলেছিলেন। পরিষ্কার করার জন্য সাফাই কর্মীকে ডাকতেই ঝাঁজিয়ে ওঠেন সিস্টার— ‘বলেছিলাম আয়া রাখতে।’’ সেই বমি পরিষ্কার করতে আর তাঁর বাবা একটা কাপড় ধোয়ার জন্য ২০০ টাকা গুনতে হয়েছে ইসমাইলকে।

এমনকী সিস্টারদের মদতে ওই আয়ারাই রোগীর মুত্রাশয়ে ক্যাথেটার লাগানো, সেলাইন চালানোর মতো কাজও করে থাকেন বলে অভিযোগ। সম্প্রতি পুরুষ ওয়ার্ডের এক বৃদ্ধ রোগীকে ক্যাথেটার লাগাতে গিয়ে রক্তরক্তি ঘটে গিয়েছে বলেও অভিযোগ। কিন্তু সে সব কিছুই নাকি লিখিত ভাবে জানানো হয়নি সুপারকে। তাই কিছুই জানেন না শিশিরবাবু। তাঁর হাসপাতালে ‘খাতায় কলমে আয়া বলে কিছু নেই’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন