সম্মান: বিদায়বেলায় রেণুবালাদেবী। নিজস্ব চিত্র
তিন দিনেই তিনি সকলের আপন হয়ে গিয়েছিলেন।
শনিবার তাঁর বিদায়বেলায় তাই সকলের চোখে জল। কেউ এগিয়ে দিলেন মিষ্টি, কেউ এনে দিলেন নতুন কাপড়। কেউ আবার শাঁখ বাজালেন। শোনা গেল একজনের শুভেচ্ছা, ‘‘মাসিমা ভাল থাকবেন।’’ এক মহিলা তাঁকে ‘মা’ ডাকলেন। ছোটরা বলে উঠল, ‘‘ঠাকুমা আবার আসবে।’’
‘‘সকলে সুখে থেকো, শান্তিতে থেকো’’— আবেগভরা গলায় এই বলে শনিবার দুপুরে কোন্নগরের নবগ্রাম ছেড়ে কলকাতা পাড়ি দিলেন ছেলে-বৌমার সংসারের ‘বোঝা’ রিষড়ার ৭৫ বছরের রেণুবালা দে। নবগ্রামের অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের বারান্দা থেকে তাঁর নতুন ঠিকানা হল কলকাতায় ওই সংস্থার বৃদ্ধাশ্রম।
ঝিরঝিরে বৃষ্টির মধ্যে বুধবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত নবগ্রামে একটি ক্লাবের পাশে বসে কাঁদছিলেন রিষড়ার বারুজীবী এলাকার বাসিন্দা রেণুবালাদেবী। সাহায্যে এগিয়ে আসেন স্থানীয়েরা। বৃদ্ধা তাঁদের জানান, নতুন ভাড়াবাড়ি খোঁজার নাম করে ছেলে বাপি তাঁকে ওখানে রেখে চলে যায়। আর ফেরেনি। ছেলে-বৌমার সংসারে তিনি বোঝা হয়ে গিয়েছিলেন, এমন অভিযোগও করেন। নবগ্রামের ওই বাসিন্দারা এলাকার অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের বারান্দায় বৃদ্ধার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। কলকাতার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি সে কথা জানতে পেরে শনিবার সকালে গাড়ি নিয়ে হাজির হয়। সংস্থাটির সদস্য অলোক লাহিড়ী জানান, তাঁরা গরিব ও অসহায় মানুষদের জন্য কাজ করেন। তাঁদের থাকা-খাওয়ারও ব্যবস্থা করেন। তিনি বলেন, ‘‘শেষ জীবনে যাতে কোনও দুঃখকষ্ট ভোগ করে না-হয়, তাই রেণুবালাদেবীকে আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রাখা হবে।’’
রেণুবালাদেবীকে ছেড়ে দিতে হবে, এ কথা জানার পরেই মন ভার হয়ে ওঠে নবগ্রামের ওই বাসিন্দাদের। তবু তার মধ্যেই বৃদ্ধাকে সাজিয়ে দেওয়া হয়। কপালে চন্দনের তিলকও পরিয়ে দেওয়া হয়। রেণুবালাদেবী যখন গাড়ির দিকে এগোচ্ছেন, তখন শাঁখ বেজে ওঠে। উলুধ্বনিও দেন কেউ কেউ। মিনতি সরকার নামে এক মহিলা বলেন, ‘‘অসহায় মানুষটা তিন দিনেই আমাদের যে এত আপন হয়ে উঠবেন, ভাবিনি। ওঁর ছেলে কী ভাবে মাকে ফেলে পালাল?’’ নিবেদিতা লাহিড়ী নামে আর এক মহিলা বলেন, ‘‘মনটা খারাপ লাগছে। এমন মানুষ কখনও বোঝা হতে পারেন?’’
দু’চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছিল রেণুবালাদেবীর। যাওয়ার আগে সকলকে আশীর্বাদ করলেন। আর বলে গেলেন উপলব্ধির কথা— ‘‘পর যে কতটা আপন হতে পারে, এই বয়সে এসে বুঝলাম।’’