গোন্দলপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক রণজিৎকুমার দাস, হিরালাল চৌধুরী এবং সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়।
সকলেরই বয়স ৫৮ পেরিয়েছে। কেউ পাড়ার কেটারিং সংস্থায় জোগাড়ের কাজ করছেন। কেউ অসুস্থ শরীরে বিবাহিত মেয়ের আর্থিক সাহায্যে দিন গুজরান করছেন। আবার কেউ খুঁজে নিয়েছেন দিনমজুরি।
বহু টালবাহানার পরে ফের বৃহস্পতিবার থেকে গেট খুলেছে চন্দননগরের গোন্দলপাড়া জুটমিলের। কিন্তু সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত অন্তত সাড়ে ৩০০০ শ্রমিক পরিবারের বেহাল দশা। বেশিরভাগ অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকই বকেয়া গ্র্যাচুইটির টাকা পাননি। কর্তৃপক্ষের দরজায় দরজায় ঘুরলেও পেনশন চালু হয়নি বলে অভিযোগ। ফলে, তাঁদের দিন গুজরানই এখন কঠিন হয়ে গিয়েছে।
১৯৮০ সাল থেকে ওই মিলের ‘ফিনিশিং’ বিভাগে কাজ করেছেন ভদ্রেশ্বরের তেলেনিপাড়ার বাসিন্দা সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়। গত বছরের জুলাইতে অবসর নেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের থেকে বকেয়া প্রায় তিন লক্ষ টাকা এখনও পাননি বলে তাঁর অভিযোগ। চালু হয়নি পেনশনও। এই পরিস্থিতিতে তাঁর সংসার চালানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সুব্রতবাবু বলেন, ‘‘কী করব? উপায় তো নেই। পাড়ার একটি কেটারিংয়ে জোগাড়ের কাজ করছি। কিন্তু সেই আয়ে কী হয়? মাসে তিন-চার দিন কাজ পাই। অনেক সময়ে তাই প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকায় হাত পড়ছে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
একই রকম করুণ পরিস্থিতি হিরালাল চৌধুরীরও। তিনি ওই মিলের সেলাইঘরে কাজ করেছেন। তাঁর তিন মেয়ে, এক ছেলে। দুই মেয়ে আর ছেলের বিয়ে হয়েছে। আর এক মেয়ে বিবাহযোগ্যা। ইদানীং হিরালালের শরীরটাও ভাল যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন
ধরে হাঁপানি এবং উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন। অসুস্থ স্ত্রী মতিহারিও। হিরালালের ক্ষোভ, ‘‘গ্র্যাচুইটি, পেনশন কিছুই চালু হয়নি। অসুস্থ শরীর নিয়ে বার বার যাচ্ছি। আমার বড় মেয়ে-জামাই আর্থিক সাহায্য করে। তাতে ওষুধ কিনতেই অনেক টাকা বেরিয়ে যাচ্ছে। ছেলের নিজের তো সংসার আছে। ওই বা কী করে?’’
ভদ্রেশ্বরের বাগপাড়ার বাসিন্দা রণজিৎকুমার দাস গত বছর জুলাইতে ওই মিল থেকে অবসর নেন। এ পর্যন্ত পেনশনের সামান্য দেড়-দু’হাজার টাকাও চালু হয়নি তাঁর। গ্র্যাচুইটি বাবদ দু’লক্ষেরও বেশি টাকা তাঁর পাওয়ার কথা। কিন্তু পাননিবলে তাঁর অভিযোগ। মিলের সুতোর রোল তৈরির বিভাগে দীর্ঘদিন কাজ করে শরীরেও নানা রোগ বাসা বেঁধেছে। যকৃতের সমস্যাতেও ভুগছেন। ফলে, অন্যদের মতো ছোটখাটো কোনও কাজ জুটিয়ে নেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। তাঁর স্ত্রীও অসুস্থ। তিনি বলেন, ‘‘পড়াশোনার খরচ মারাত্মক বেড়ে গিয়েছে। চাকরি করে দুই ছেলেকে স্নাতক করিয়েছি। কিন্তু ওরা এখনও ভাল চাকরি পেল না। আশা ছিল, একটা ছেলেও যদি সরকারি চাকরি পায়, তা হলে সংসারটা দাঁড়িয়ে যায়। তা আর হল কই?’’
প্রায় একই রকম দুঃখের কাহিনি রয়েছে বেশির ভাগ অবসরপ্তাপ্ত শ্রমিকেরই। কোনও উপায় না-পেয়ে তাঁদের অনেকে পেনশন এবং গ্র্যাচুইটি-র জন্য চন্দননগরের ‘আইন সহায়তা কেন্দ্রে’র দ্বারস্থ হয়েছেন। ওই কেন্দ্রের কর্ণধার বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অন্তত সাড়ে তিন হাজার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক তাঁদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছেন না। এই বকেয়া টাকার পরিমাণ অন্তত ৩০ কোটি। মিল যে ১১ মাস বন্ধ ছিল, তার মধ্যেই কর্তৃপক্ষ ১৩০ জনকে অবসরের নোটিস ধরিয়েছেন।’’
অবসরপ্রাপ্তদের পাওনা নিয়ে মিলের পার্সোনেল বিভাগের এক কর্তা বলেন, ‘‘আর্থিক মন্দার কারণেই মিল বন্ধ হয়েছিল। দেশ জুড়েই চট শিল্পে মন্দা চলছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে শ্রমিকদের বকেয়া মেটাতে।’’
তবু আশ্বস্ত হতে পারছেন না বর্তমান এবং অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকেরা। তাঁদের খেদ, যে ভাবে এই মিল খোলা-বন্ধের ‘খেলা’ চলে, তাতে তাঁদের দিন গুজরান করাই কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বকেয়া যে মিলবেই, সে ভরসা কোথায়?