প্রশাসনের নজর এড়িয়ে দ্বারকেশ্বর সেতুর স্তম্ভের গা থেকেই তুলে নেওয়া হচ্ছে বালি। আরামবাগে তোলা নিজস্ব চিত্র।
পরিকাঠামোর অভাবে নজরদারিতে ঘাটতি রয়েছেই। এখন আবার সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক আধিকারিকদের নির্বাচনের ব্যস্ততা। এই পরিস্থিতিতে একেবারেই আগলহীন বালিখাদানগুলি। আর তারই সুযোগে সেচ দফতরের অধীন আরামবাগ মহকুমার নদীগুলি থেকে শুরু হয়েছে বালি লুঠের উৎসব।
বালি খাদানের বৈধ অনুমতি নেওয়া যে গুটিকয়েক খাদান মালিকের কাছ থেকে কিছু রাজস্ব আদায় হচ্ছিল, নির্বাচনী বিধির গেরোয় চালান ইস্যু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই রাজস্ব আদায় তো বন্ধই। পাশাপাশি বৈধ বালি খাদ মালিকদের একটা অংশও বালি লুঠের উৎসবে সামিল হয়েছেন। অবস্থার কথা মহকুমা সেচ দফতরের কর্তারা জেলা দফতরে জানিয়েছেনও।
জেলা সেচ দফতরের সহকারি রেভিনিউ অফিসার সুনীলকান্তি ভট্টাচার্য বলেন, “গত ৪ মার্চ থেকে নির্বাচনী বিধি বহাল হয়ে যাওয়ায় নতুন চালান ইস্যু বন্ধ। যাঁদের আগে থেকে চালান কাটা আছে কেবল তাঁরাই চালানে উল্লিখিত নির্দিষ্ট দিন পর্যন্ত নির্দিষ্ট পরিমাণ বালি তুলতে পারবেন। বেআইনি ভাবে বালি তোলা রুখতে সারা বছর ধরেই অভিযান চলে। বর্তমান পরিস্থিতিতে মহকুমাস্তরে কড়া পদক্ষেপ করতে বলা হয়েছে।”
কিন্তু কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার পরিকাঠামো কী রকম?
হুগলি জেলার মূল বালির ক্ষেত্র বলতে আরামবাগ মহকুমার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া দামোদর, মুন্ডেশ্বরী এবং দ্বারকেশ্বর নদী। দামোদর নদীর পুরোটা এবং মুন্ডেশ্বরী নদীর আংশিক দেখভালের দায়িত্ব চাঁপাডাঙা মুন্ডেশ্বরী সেচ দফতরের। অন্যদিকে দ্বারকেশ্বর নদীর পুরোটা এবং মুন্ডেশ্বরী নদীর আংশিক আরামবাগ সেচ দফতরের অধীন। দুটি দফতরেই অনুমোদিত পদের অর্ধেকেরও কম কর্মী আছেন। আরামবাগ সেচ দফতরে অনুমোদিত পদ ৪৬টি, আছেন ২২ জন। সামনের মাসেই আরও ৪ জন অবসর নেবেন। একই হাল মুন্ডেশ্বরী সেচ দফতরের। নামমাত্র কর্মী নিয়ে একদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণে বাঁধের তদারকি অন্যদিকে বালির নজরদারি তাঁরা সামলাতে পারছেন না বলে স্বীকারও করেছেন সংশ্লিষ্ট দুই দফতরের আধিকারিকরা।
মহকুমার নদীগুলি থেকে বালি চুরির রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের নেতাদের লক্ষ থাকে বালিখাদের অংশীদার হওয়া। বৈধ ও অবৈধ বালিখাদান নিয়ে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ভাবে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ জড়িত বলে সংশ্লিষ্ট এলাকার পঞ্চায়েত এবং খাদান মালিক সূত্রে জানা গিয়েছে। বৈধ বালি খাদের মালিকরাও যে পরিমাণ বালি তোলার পারমিট পান বা পারমিটের জন্য আবেদন করেন, তার চেয়েও অনেক বেশি বালি তুলে নেন। গাড়ি ওভারলোড করে বালি বোঝাইয়ের ঘটনা নিত্যদিনের ঘটনা। মহকুমায় বালি চুরি বর্তমানে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বালি তোলার নিষিদ্ধ এলাকাও মানছে না চোরেরা। নদীগুলির সেতুর পিলারের গা থেকেও বালি সাফ হয়ে যাচ্ছে।
আরামবাগ মহকুমা সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁদের অধীনে দ্বারকেশ্বর এবং মুণ্ডেশ্বরী নদীতে বৈধ বালি খাদের সংখ্যা ২০টি। অন্যদিকে চাঁপাডাঙার মুন্ডেশ্বরী সেচ দফতরের অধীনে বৈধ বালি খাদের সংখ্যা ৩০টি। কিন্তু বৈধ বালিখাদ মালিকদের অভিযোগ, ওই তিনটি নদীতে বেআইনি ভাবে বালিখাদ চলছে ৯০টিরও বেশি। তাঁদের অভিযোগ, “সেচ দফতর ওই সব বেআইনি খাদানে অভিযান চালায় না। তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যাবস্থাও নেওয়া হয় না।’’
বর্তমানে নির্বাচনী বিধির কারণে চালান ইস্যু বন্ধ থাকা সত্ত্বেও অনেক বৈধ খাদান মালিক অবৈধভাবে বালি তুলছেন। কিন্তু কেন?
পুরশুড়ার ডিহিবাতপুরের বাসিন্দা তথা দামোদরে ৬টি বালি খাদানের এক মালিকের কথায়, “প্রথমত আমরা বুঝতে পারছি না নির্বাচন বিধির মধ্যে এই চালান ইস্যুকে কেন ফেলা হল! এর ফলে একদিকে যেমন সরকারের রাজস্ব আদায়ের পথ বন্ধ হচ্ছে, অন্যদিকে এক একটি বালি খাদ পিছু অন্তত ২০ থেকে ২২ জন শ্রমিক কাজ করেন। এতে তাঁদেরও জীবিকা বিপর্যস্ত হচ্ছে। শ্রমিকদের স্বার্থে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে নানা চাপের মুখে বালি খাদ চালু রাখতে হয়েছে অনেককে।’’
যদিও কী ধরনের চাপ তা নিয়ে মুখ খুলতে চাননি তিনি। বৈধ বালিখাদ মালিকদের বক্তব্য, নির্বাচন বিধির আওতা থেকে চালান ইস্যুর বিষয়টি বাদ দেওয়ার জন্য সেচ দফতরের কাছে দাবি জানানো হয়েছে।