আমাদের ছেড়ে যাবেন না স্যার, আর্জি পড়ুয়াদের

প্রতিদিনের মতোই প্রার্থনা শেষ হওয়ার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে চলে যেতে বলে নিজের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়ুয়ারা। কারও হাতে লেখা, ‘স্যার আপনাকে আমরা খুব ভালোবাসি। আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’ আবার কারও হাতে লেখা, ‘আপনি থাকছেন স্যার’।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৬ ০০:৩৩
Share:

ছাত্রদের হাতে ‘ঘেরাও’ প্রধান শিক্ষক তাপস চট্টোপাধ্যায়। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার

প্রতিদিনের মতোই প্রার্থনা শেষ হওয়ার পরে ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাসে চলে যেতে বলে নিজের ঘরে গিয়ে বসেছিলেন প্রধান শিক্ষক। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি খেয়াল করলেন, তাঁর ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়ুয়ারা। কারও হাতে লেখা, ‘স্যার আপনাকে আমরা খুব ভালোবাসি। আপনি আমাদের ছেড়ে যাবেন না।’ আবার কারও হাতে লেখা, ‘আপনি থাকছেন স্যার’।

Advertisement

বেঁড়াচাপা বীণাপাণি বালিকা বিদ্যালয়ের পরে বেলুড় উচ্চ বিদ্যালয়। গত ২৯ জুন উত্তর ২৪ পরগনার ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার বদলি আটকাতে তাঁকে চোখের জলে ঘেরাও করে রেখেছিল ছাত্রীরা। মঙ্গলবার বেলুড়েও ঘটল একই ঘটনা। ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাপস চট্টোপাধ্যায় নিউ আলিপুরের একটি স্কুলে বদলি নিয়ে চলে যাওয়ার খবর চাউর হতেই তাঁকে আটকাতে মরিয়া হয়ে ওঠে ছাত্র-ছাত্রীরা। শিক্ষক-শিক্ষিকারাও তাপসবাবুকে বলতে থাকেন, ‘‘স্যার আপনি সিদ্ধান্ত
বদল করুন।’’

কার্যত এ ভাবেই মঙ্গলবার দিনভর ঘেরাও হয়ে রইলেন তাপসবাবু। বেলুড়ের এই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার আগে বালি জোড়া অশ্বত্থতলা উচ্চ বিদ্যালয়ে ১৩ বছর পড়িয়েছেন শিবপুরের বাসিন্দা ওই শিক্ষক। ২০০৫-এর মার্চে বেলুড় উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক পদে যোগ দেন। পড়ুয়াদের কথায়, ‘‘স্যার খুব কড়া মনোভাবের। কিন্তু পড়াশোনার বাইরে উনি বন্ধুর মতো মেশেন। খুব ভালো পড়ান। তাই ওঁকে থাকতেই হবে।’’ এ দিন পঠনপাঠন কার্যত বন্ধ করে স্যারের থেকে চলে না যাওয়ার প্রতিশ্রুতি আদায় করতেই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল পড়ুয়ারা।

Advertisement

এর আগে প্রিয় চিকিৎসক, বিডিও, পুলিশ অফিসারের বদলি আটকাতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখেছেন রাজ্যের মানুষ। ১৯৯৪ সালে তারাপীঠের কাছে তারাপুর প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক অভিজিৎ রায়চৌধুরীর বদলি আটকাতে রাস্তায় নেমেছিলেন গ্রামবাসীরা। পরিস্থিতি সামলাতে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। তাতে তিন জন মারাও গিয়েছিলেন। বাস্তবের এই ঘটনা নিয়ে পরে সিনেমাও
তৈরি হয়েছে।

তবে বেলুড়ের এই ঘটনায় পুলিশ ডাকতে হয়নি প্রধান শিক্ষককে। কিন্তু তেমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। কেননা, এক সময়ে পড়ুয়াদের হাত থেকে বাঁচতে স্কুলের বাইরে বেরিয়ে পড়েছিলেন তাপসবাবু। তাঁর পিছনে ধাওয়া করে জি টি রোডে বেরিয়ে পড়ে পড়ুয়ারাও। দাবি তোলে, ‘স্যার আমাদের সঙ্গে না থাকলে রাস্তা অবরোধ করব।’ শেষমেশ পড়ুয়াদের বুঝিয়ে স্কুলের ভিতরে নিয়ে যান তাপসবাবু।

ওই শিক্ষক জানিয়েছেন, শিবপুরের বাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে তিনি কলকাতার দিকে যেতে চাইছেন। সেখানেই বাড়ির কাছের এক স্কুলে ‘মিউচুয়াল ট্রান্সফার’-এর আবেদন করেছিলেন। সেই মতো তাঁর বদলি হয়েছে নিউ আলিপুরের সাহাপুর মথুরানাথ ইনস্টিটিউশনে। এ দিন বেলুড়ের স্কুলে নিজের ঘরে বসে তাপসবাবু বলেন, ‘‘কী যে করি, বুঝতেই পারছি না। এত আবেগে আটকে যাব ভাবিনি। কিন্তু সিদ্ধান্ত বদল করাও সম্ভব নয়।’’

কেন প্রধান শিক্ষকের বদলি আটকাতে চাইছে সবাই? পড়ুয়া সঞ্জয় নন্দী, রাজীব রায়, প্রতীক সিংহদের কথায়, ‘‘স্যার আমাদের বন্ধুর মতো। পড়াশোনার বাইরে উনি এক অন্য মানুষ। স্কুলের অনেক উন্নতি করেছেন। কার কী সমস্যা, খোঁজ নিয়ে মেটানোর চেষ্টা করেন।’’ বাংলার শিক্ষক নবকুমার সরকার বলেন, ‘‘স্যার সকলের প্রিয়। আমরাও ওঁকে চিঠি দিয়ে না যাওয়ার আবেদন জানিয়েছি। সবার আবেগ, ভালোবাসার কথা ভেবে ওঁর থেকে যাওয়া উচিত।’’

এ দিন কখনও প্রধান শিক্ষকের ঘরের সামনে, কখনও স্কুলের বারান্দায়, কখনও আবার মাঠে ধর্নায় বসে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়ারা। কেউ না যাওয়ার আর্জি জানিয়ে চিরকুটে লিখে হেডস্যারের ঘরের জানলা দিয়ে ছুড়ে দিয়েছে। কয়েক জন আবার দাবি তুলেছে, প্রয়োজনে তারা শিক্ষামন্ত্রীকেও চিঠি লিখবে। সারা রাত ধর্নায় বসে থাকবে। আর, নিজেদের পকেটের টাকা দিয়ে খাবার কিনে প্রিয় হেডস্যারকে খাওয়াবে।

আর এ সব দেখেশুনে মাথায় হাত দিয়ে টেবিলে মুখ গুঁজে বসে থেকেছেন বিজ্ঞানের শিক্ষক তাপসবাবু। কখনও উদ্‌ভ্রান্তের মতো পায়চারি করেছেন বারান্দায়। আর বলেছেন, ‘‘এতটা বাড়াবাড়ি হবে আগে বুঝিনি। এখন যে কী করি!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন