গঙ্গায় ভেসে দশ বছরের কিশোরের দেহ নিয়ে ভেলা ভিড়ল চন্দননগরে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, তাকে সাপে ছোবল দিয়েছে। দৈবের ভরসায় মৃতদেহ ভেলায় ভাসিয়েছেন পরিজনেরা।
সম্প্রতি তারকেশ্বরে দু’জনকে ছোবল দিয়েছিল সাপ। তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় ওঝার কাছে। এক গ্রামবাসীর উদ্যোগে পুলিশ তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি করায়। প্রাণে বাঁচেন সর্পদষ্টেরা।
সম্প্রতি বলাগড় ব্লকের ডুমুরদহে স্কুলপড়ুয়া কিশোরীকে ছোবল দেয় সাপ। তাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওঝার কাছে। অবস্থার অবনতি হলে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় মেয়েটিকে বাঁচানো যায়নি।
হাসপাতালের পরিবর্তে ওঝার ‘বুজরুকি’র উপর ভরসার ঘটনা হুগলির গ্রামেগঞ্জে পরিচিত দৃশ্য। আজও কেন ঝাঁড়ফুকে ভরসা রাখেন মানুষ? কেন কুসংস্কারের বেড়া ভেঙে মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় না চিকিৎসা বিজ্ঞানের সুফলকে? নানা ঘটনায় এমনই প্রশ্ন ওঠে।
কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত লোকজনের বক্তব্য, এক শ্রেণির লোক ধর্মীয় বিশ্বাসের মোড়কে বুজরুকি চালিয়ে যান। ধর্মের যোগ থাকায় বিষয়টি স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে।
পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের রাজ্য কাউন্সিলের সদস্য চন্দন দেবনাথ বলেন, ‘‘মনসামঙ্গলের কাহিনী বহু মানুষের কাছেই বিশ্বাসযোগ্য।দৈব ক্ষমতাধারী হিসেবে চিহ্নিত ওঝা-গুণিনের কাছে ছোটেন মানুষ। সর্পদষ্টের চিকিৎসা নিয়ে ধারণা কম থাকায় বিষয়টি আরও ইন্ধন পায়। মানুষকে বোঝানো দরকার।’’
সর্প বিশারদরা জানান, এ রাজ্যে মূলত চন্দ্রবো়ড়া, কেউটে, গোখরো এবং কালাচের ছোবলে মানুষ মারা যায়। শাঁখামুটি প্রবল বিষধর হলেও তাদের কামড়ের তেমন নজির নেই। অন্যান্য প্রজাতির প্রায় সব সাপই নির্বিষ। কিন্তু এ নিয়ে মানুষের ধারণা নেই। নির্বিষ সাপের ক্ষেত্রে স্বভাবতই মৃত্যু হয় না। কিন্তু বিষয়টিকে ওঝা নিজের সাফল্য বলে প্রচার করেন। তাতে তাঁদের উপরে বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়। অন্ধবিশ্বাস আরও জাঁকিয়ে বসে। বহু শিক্ষিত লোকও এই ভাবনার শিকার।
রাজ্যের স্নেকবাইট রিসোর্স পার্সন, চিকিৎসক দয়ালবন্ধু মজুমদারের কথায়, ‘‘ওঝা গ্রামে বসে চব্বিশ ঘণ্টা প্রচার করে চলেছেন। সরকার বা বিজ্ঞানমনস্ক সংগঠনের প্রচার ছাপিয়ে ওঁদের কথাই মানুষের কানে ঢুকছে বেশি। তার উপর বংশ পরম্পরায় মানুষ দেখে আসছে, সাপে ছোবল দিলে এঁদের কাছে যেতে হয়। তাই সবাই ওঝার বাড়ি ছুটছেন।’’
মনোবিদ মোহিদ রণদীপের বক্তব্য, ‘‘ছোট থেকেই আমরা তাবিজ-কবজ-মাদুলি, আংটি, ঠাকুর-দেবতার বিশ্বাসে বড় হই। ফলে এই সব বিশ্বাস মনে গেঁথে যায়। প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে ছেলেমেয়েদের বিজ্ঞান পড়ানো হলেও বিজ্ঞানমনস্কতা গড়ে ওঠার পক্ষে তা যথেষ্ট নয়। সব মিলিয়ে ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কারের যেন চাষ-আবাদ চলে সমাজে।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘টিভিতে আজকাল এই সব নিয়ে নানা সিরিয়ালও হচ্ছে। সেখানে বিজ্ঞানমনস্কতার বদলে কুসংস্কারকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়। সেটাও এই সমাজের পক্ষে ক্ষতিকারক।’’ চলবে