ঘটনায় গ্রেফতার চারজনকে আদালতে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সুব্রত জানার ছবি।
খবরের কাগজে, টিভিতে নারী নির্যাতনের নানা ঘটনা দেখে-শুনে চিন্তা হতো। কারণ তাঁর মেয়েরও তো কলেজ থেকে টিউশন সেরে ফিরতে রাত হয়। তাই একা নয়, বন্ধুদের সঙ্গে ফিরতে বলতেন। বলতেন রাস্তাঘাটে সতর্ক থাকার কথা। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যায় যে তাঁরই মেয়ের উপরে আক্রমণ নেমে আসবে, কল্পনাও করতে পারেননি তিনি। ঘটনায় চারজন গ্রেফতার হলেও আতঙ্ক কাটছে না তরুণীর বাবার। বার বার একটাই প্রশ্ন করছেন, ‘‘রাস্তাঘাটে মেয়েদের কী নিরাপত্তা নেই?’’
বস্তুত, বুধবার সন্ধ্যায় বাগনানের বাঁশবেড়িয়া গ্রামে কলেজছাত্রী এক তরুণীকে ধর্ষণের চেষ্টা ও মারধরের ঘটনায় এই প্রশ্ন শুধু আর ওই ছাত্রীর পরিবারের নয়। তাঁর পরিবারের মতোই আরও অনেকের।
পুলক ধাড়া নামে এক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘ইভটিজারদের দৌরাত্ম্য যে বাড়ছে সে বিষয়ে পঞ্চায়েতে জানিয়েছিলাম। আবেদন জানিয়েছিলাম, পুলিশকে জানিয়ে যেন কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু কোথায় কী? শেষ পর্যন্ত আমাদের আশঙ্কাই সত্যি হল।’’ মনতোষ বেরার কথায়, ‘‘আমার মেয়ে ছোট। কিন্তু সেও একদিন স্কুল কলেজে যাবে। তা ছাড়া পরিবারের অন্য মেয়েরা স্কুল কলেজে যাচ্ছে। কামদুনিতে কলেজ থেকে ফেরার পথে ধর্ষিতা হয়েছিলেন এক ছাত্রী। কয়েক মাস আগে উদয়নারায়ণপুরের পাঁচারুলেও এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হয়। এ ভাবে যদি বারবার মেয়েদের উপরে হামলা হতে থাকে তা হলে আমাদের মতো সাধারণ পরিবারের মেয়েদের নিরাপত্তা কে দেবে? প্রশাসনের কী কিছু করার নেই?’’
ঠিক কী ঘটেছিল বুধবার সন্ধ্যায়?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, ওই কলেজ ছাত্রী বুধবার কলেজের পর গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ে বাগনান থেকে দুই বান্ধবীর সঙ্গে কামারদহে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনজনে ট্রেনে বাগনান থেকে দেউলটি স্টেশনে নামেন। তারপর সাইকেলে বাড়ির দিকে রওনা দেন। দুই বান্ধবীর একজনের বাড়ি কামারদহে ও অন্যজনের বাড়ি পাশেই বাঁকুড়দহ গ্রামে। বাড়ির পথেই পড়ে বাঁশবেড়িয়া গ্রাম। তারপর বেশ কিছুটা পথ নির্জন। তরুণীর এক বান্ধবীর কথায়, ‘‘তিনজনেই একসঙ্গে আসছিলাম। বাঁশবেড়িয়ার কাছে আমরা দু’জন একটু এগিয়ে গিয়েছিলাম। হঠাৎ কানে আসে ওর চিৎকার। শুনে বুঝতে পারি ওর কিছু একটা হয়েছে। সাইকেল ঘুরিয়ে আমরা গিয়ে দেখি ও মাঠে পড়ে আছে। দেখি দু’দন ছেলে মাঠ দিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও চিৎকার করি। চিৎকারে গ্রামের লোকজন বেরিয়ে এসে ওই দু’জন ছেলেকে ধরে ফেলে। পরে বান্ধবী জানায়, চারজন ওর উপরে হামলা চালিয়েছিল।’’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, চিৎকার শুনে তাঁরা দু’জনকে পাকড়াও করে আটকে রেখেছিলেন পুলিশ দেবেন বলে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই আরও দুই যুবক তাদের ছাড়াতে এলে তাদেরও আটকে রাখা হয়। পরে পুলিশ এসে চারজনকে গ্রেফতার করে।
মারের চোটে জখম ওই ছাত্রীকে বুধবার রাতেই হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। বৃহস্পতিবার দুপুরে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান তিনি। কিন্তু চোখেমুখে তখনও আতঙ্ক। বললেন, ‘‘ওই রাস্তা দিয়েই রোজ বাড়ি ফিরি। দেউলটি পেরোনোর পর প্রায় প্রতিদিন ওরা আমাদের প্রতি অশালীন মন্তব্য করত। মাঝেমধ্যে পথ আগলে দাঁড়াত। কিন্তু এ দিন আমাকে একা পেয়ে সাইকেল থেকে নামিয়ে জোর করে মাঠের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। বাধা দিলে মারতে থাকে। মরিয়া হয়ে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ চিৎকার শুরু করি। বন্ধুরা না এলে কী যে হতো...।’’ কান্নায় ভেঙে পড়েন তরুণী।
ঘটনার পরে আক্রান্ত তরুণীর পরিবার তো বটেই, গ্রামবাসীরাও আতঙ্কিত। তরুণীর দুই বান্ধবীর বাবাই জানালেন, ‘‘কী ভরসায় মেয়েদের পড়াশোনা করাতে বাইরে পাঠাব বলতে পারেন?’’
পুলিশ কী বলছে?
হাওড়া গ্রামীণ জেলা পুলিশের এক কর্তা জানান, দুষ্কৃতীদের কয়েকজনকে ধরা হয়েছে। বাকিদের খোঁজে তল্লাশি চলছে। ঘটনায় যুক্ত কেউ রেহাই পাবে না। স্থানীয় থানার বত্তব্য, ওই জায়গায় ইভটিজিং নিয়ে আগে কেউ অভিযোগ করেননি। তবে ঘটনার পর এলাকায় টহলদারির ব্যবস্থা হয়েছে। কোনও অভিযোগ পেলেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মহিলাদের নিরাপত্তায় কোনও ফাঁক রাখা হবে না।
ঘটনা যে এলাকার সেই ওড়ফুলি পঞ্চায়েতের প্রধান তথা স্থানীয় তৃণমূল নেতা শ্রীকান্ত সরকার ঘটনার নিন্দা করে বলেন, ‘দোষীদের কড়া শাস্তির জন্য পুলিশকে বলা হয়েছে। জড়িত বাকিদেরও অবিলম্বে ধরতে বলা হয়েছে।’’ তিনি জানান, এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে এলাকায় পুলিশি টহলের পাশাপাশি পঞ্চায়েতের তরফেও নজরদারি চালানো হবে।
স্থানীয় সিপিএম নেতা ভাস্কর রায় বলেন, ‘‘ইভটিজিং রুখতে প্রশাসনকে আরও কড়া হতে হবে। না হলে, এমন ঘটনা ঘটতেই থাকবে।