মোহনলাল মণ্ডল।—নিজস্ব চিত্র।
লজঝড়ে সাইকেলে চেপে যখন গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন অনেকেই আড়ালে তাঁকে ‘পাগল’ বলতেন। কেউ কেউ আবার ডেকে বাড়ির দাওয়ায় বসাতেন। তবে তাঁর শিক্ষকতা, জ্ঞান সকলের শ্রদ্ধা আদায় করে নিয়েছিল। ২০১৪ সালে শিক্ষক দিবসে ষাট ছুঁইছুঁই সেই মানুষটিকেই শিক্ষারত্ন সম্মান দিল রাজ্য সরকার।
আপনি যে জেলায় থাকেন সেই জেলায় মন্দির-মসজিদের সংখ্যা কত? আপনার বাড়ির পাশের মন্দির-মসজিদ তৈরির ইতিহাস কী আপনি জানেন? আপনার পাড়ার আদি বাসিন্দা কারা ছিলেন? এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই গ্রামে গ্রামে ঘুরতে শুরু করেছিলেন হাওড়ার প্রশস্ত দুর্লভচন্দ্র সাহা বিদ্যাপীঠের বাংলার শিক্ষক মোহনলাল মণ্ডল। তখন আশির দশকের শেষের দিক। সেই থেকে শুরু। ক্রমে ক্রমে গ্রামগঞ্জের লৌকিক ইতিহাসের অআকখ খুঁজতে খুঁজতেই মোহনলালবাবু শেষ করেছেন তাঁর গবেষণার কাজ। বিষয় ছিল হাওড়া জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস। গবেষণার কাজ শেষ হওয়ার পর লিখেছেন আন্দুল মৌড়ির ইতিবৃত্ত, হাওড়া জেলার লৌকিক দেবদেবীর মতো বেশ কিছু বই। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার মাধ্যমে লোকে জেনেছে প্রশস্ত গ্রামের ইতিহাস। জেনেছে পুঁইল্যা গ্রামের ইতিবৃত্ত। যার উপকরণ খুঁজতে তাঁকে ছুটে বেড়াতে হয়েছে হাওড়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে।
আদি বাড়ি বাঁকুড়া জেলার ওন্দা থানার বিনোদনগর গ্রামে। বাবা ছিলেন পাঁচালি গায়ক ও কবিরাজি চিকিৎসক। বাবার সঙ্গেই বাঁকুড়ার বিভিন্ন গ্রামে ঘোরার সূত্রে তখন থেকেই লৌকিক দেবদেবীর ইতিহাস নিয়ে আগ্রহ ও খোঁজখবর। তাঁর কথায়, “দরিদ্র পরিবারে বড় হয়েছি। মাঠে চাষের কাজ করে কলেজ যেতাম। তখনই মনে হত রাজা-মহারাজাদের ইতিহাস তো সবাই লেখেন, কিন্তু যে মাঠে ধান বুনছি তার ইতিহাস কি কেউ কখনও লিখবে? হাওড়ার গ্রামে স্কুলশিক্ষকের চাকরি পাওয়ার পর সেই ইচ্ছে আরও প্রবল হয়ে ওঠে। ছুটি থাকলেই বেরিয়ে পড়তাম।” জানালেন, হাওড়া জেলার প্রায় ১৫০০টি গ্রামে চষে বেরিয়েছেন। এখন তাঁর ধ্যানজ্ঞান আদিবাসী মানুষের জীবনচর্চা। ইতিমধ্যেই সাঁওতালদের জীবন নিয়ে বই লেখা প্রায় শেষ। শুরু করেছেন ডোমজুড়ের বিভিন্ন গ্রামের ইতিহাস লেখার কাজ।
বর্তমানে ক্ষুদ্র জনপদের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে কাজের সংখ্যা যে ক্রমেই কমছে সে বিষয়ে একমত অনেকেই। কোচবিহারের এবিএন শীল কলেজের অধ্যাপক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “বর্তমানে বেশিরভাগ গবেষণাতেই মাটির গন্ধ নেই। তাই আঞ্চলিক ইতিহাস লেখা আজ এই সময়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংখ্যায় খুব কম হলেও কিছু মানুষ একাকী এই কাজ করে যাচ্ছেন। মোহনলালবাবুকে ধন্যবাদ।” হাওড়ার মাকড়দহ বামাসুন্দরী ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক সমীর ঘোষের দাবি, মোহনলালবাবু যে কাজ করেছেন তার মূল্য বুঝবে ভবিষ্যৎ গবেষকরা।
সম্প্রতি ডোমজুড় ব্লক প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্লকের ১৮টি পঞ্চায়েতের ইতিহাস নথিবদ্ধ করার কাজ শুরু হয়েছে। সেই কাজেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন এই গবেষক শিক্ষক।