পোড়ামাটির এমন অনেক মন্দিরই আকর্ষণ বাড়িয়েছে গুপ্তিপাড়ার।-নিজস্ব চিত্র।
সংস্কৃত চর্চার অন্যতম সেরা পীঠস্থান হিসেবে এক সময়ে পরিচিতি ছিল এ তল্লাটের। এখনও টোল চলে।
ছোট্ট গ্রামে কত রকম মন্দির! তাতে টেরাকোটার কাজ।
গ্রামের রথযাত্রা কয়েকশো বছরের পুরনো। রথের দিনে লাখো মানুষের সমাগম হয়।
বহু কাল আগে গঙ্গা এবং বেহুলার ধারে গড়ে ওঠা গুপ্তিপাড়ায় এত কিছু থাকা সত্ত্বেও রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে তার সে ভাবে ঠাঁই হয়নি— এই ক্ষোভ গ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের। তবে, ক্ষোভ আঁকড়ে বসে থাকা নয়, গ্রামকে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি নিয়ে এ বার রাজ্যের গণ্ডী ছাড়িয়ে দিল্লিতে দরবার করতে শুরু করেছেন তাঁরা। এ জন্য রীতিমতো কমিটি গড়া হয়েছে। নাম ‘গুপ্তিপাড়া পর্যটন উন্নয়ন কমিটি’। সম্প্রতি দিল্লিতে গিয়ে কেন্দ্রীয় পর্যটন প্রতিমন্ত্রী শ্রীপদ নায়েকের সঙ্গে দেখা করে লিখিত দাবিও পেশ করে এসেছেন তাঁরা।
গ্রামবাসীদের প্রশ্ন, তারকেশ্বর বা কালীঘাটের মতো জায়গায় একটিই মন্দিরকে কেন্দ্র করে রমরমিয়েই চলছে পর্যটন। তা হলে সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও গুপ্তিপাড়া কেন বঞ্চিত থাকবে? কমিটির সম্পাদক বিশ্বজিৎ নাগ বলেন, “ইতিহাসের অলিন্দে থেকেও গুপ্তিপাড়া আজও পিছিয়ে পড়া জায়গা হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। এখানে পর্যটন শিল্পের জন্য সরকারকে কোনও রকম জমি অধিগ্রহণ করতে হবে না। কিন্তু উপযুক্ত পরিকাঠামো তৈরি করতে পারলে বহু গ্রামবাসী রুজি-রুটির সন্ধান পাবেন।” হুগলির সাংসদ রত্না দে নাগের আশ্বাস, “এ ব্যাপারে আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।”
হুগলির প্রত্যন্ত ব্লক বলাগড়ের অন্তর্গত গুপ্তিপাড়া। গ্রাম জুড়ে বহু দেবদেবীর থান। একের পর এক মন্দির এবং পরিবেশের কারণে গুপ্তিপাড়াকে বলা হয় ‘গুপ্ত বৃন্দাবন’। এখানে বৃন্দাবনচন্দ্র, রামসীতা, কৃষ্ণচন্দ্র, গৌরনিতাই মন্দির রয়েছে। বৃন্দাবনচন্দ্র এবং কৃষ্ণচন্দ্রের মন্দির আটচালার। রামচন্দ্রের মন্দির একচালা শৈলীর। ওই মন্দিরে পোড়ামাটির ফলকও রয়েছে। এই সব মন্দির সংবলিত বৃন্দাবনচন্দ্রের মঠ পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের আওতায় রয়েছে। তবে, উপযুক্ত সংস্কারের অভাবে মন্দিরের গায়ের নকশা জীর্ণ হয়ে পড়েছে। সেগুলির উপযুক্ত সংস্কার না হওয়ায় ক্ষোভও রয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই মন্দিরগুলির দিকে নজর দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন গ্রামবাসীরা।
এখানে সোজা রথের দিন গঙ্গা তীরবর্তী মন্দির থেকে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা গুণ্ডিচা-ঘরে আসেন রথে চেপে। মেলা বসে। বেতের ঝুড়ি, ধামা, কুলো থেকে জিলিপি— কী নেই সেখানে! অবিভক্ত বাংলার প্রথম বারোয়ারি পুজো শুরু এই জনপদেই। আড়াইশো বছর আগে বিন্ধ্যবাসিনী জগদ্ধাত্রী পুজো দিয়ে এর শুরু। এ ছাড়াও রয়েছে পরিব্রাজক কৃষ্ণানন্দ স্বামী, রঘুনাথ দেবের এই গ্রামে পাঁচশো বছরের পুরনো দেশকালী মন্দিরও রয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে নষ্ট হচ্ছে মন্দির গাত্রের স্থাপত্য।-নিজস্ব চিত্র।
গুপ্তিপাড়া পর্যটন উন্নয়ন কমিটির বক্তব্য, এই গ্রামে পর্যটন কেন্দ্রের ভাল সম্ভাবনা রয়েছে। বাম সরকারের কাছেও বিষয়টি নিয়ে দরবার করা হয়েছিল। বর্তমান রাজ্য সরকারের জানানো হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি বলে তাদের অভিযোগ। জেলা প্রশাসনের প্রকল্পে বৃন্দাবনচন্দ্র মঠের সৌন্দর্যায়নের কথা বলা হলেও ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। ওই মঠের মোহন্ত মহারাজ গোবিন্দানন্দ পুরী বলেন, “এমন ইতিহাস সমৃদ্ধ জায়গা এত দিনেও কেন পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠল না সেটা আশ্চর্যের।” একই বক্তব্য সুব্রত মণ্ডল, প্রদীপ প্রামাণিক, প্রতাপনারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সুব্রত লাহিড়ীর মতো গ্রামবাসীরও। সকলেরই অনুযোগ, এত দিন দৌড়ঝাঁপই সার হয়েছে।
গ্রামবাসীর দাবি, এখানে পর্যটকদের জন্য হোটেল, অতিথি-আবাস তৈরি করার মতো পর্যাপ্ত জায়গা রয়েছে। রেলপথে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লুপ লাইনে গুপ্তিপাড়া স্টেশন হয়ে গ্রামে ঢোকা যায়। সড়কপথেও যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে। অসম লিঙ্ক রোড বা এসটিকেকে রোড (সপ্তগ্রাম-ত্রিবেণী-কালনা-কাটোয়া সড়ক) এই গ্রামের উপর দিয়েই গিয়েছে। তবে, পর্যটনকেন্দ্র হলে রাস্তাঘাট আরও ঝাঁ-চকচকে করা দরকার। দরকার আধুনিক মানের বাসস্ট্যান্ড। রাস্তার দু’ধারে এবং গ্রামের ভিতরে আধুনিক আলো লাগানো দরকার। মনোরম পরিবেশের জন্য পাশের চরকৃষ্ণবাটিতেও ইকো-ট্যুরিজম পার্ক গড়া যায় বলে মনে করছেন গ্রামবাসী।
গুপ্তিপাড়ার একদিকে বর্ধমান। গঙ্গার ও পারে নদিয়া। ও পারে শান্তিপুর, নবদ্বীপে দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক যান। পর্যটনকেন্দ্র গড়ে উঠলে তাঁরা সহজেই জলপথে গুপ্তিপাড়ায় আসতে পারবেন। কিন্তু পর্যটনের সেই প্রসার কবে হবে? অপেক্ষায় গুপ্তিপাড়া।