কাটেনি আতঙ্ক। রুমাদেবী তাঁর মেয়ে। ছবি: তাপস ঘোষ।
বীরভূমের পর হুগলি। ফের মহিলাদের উপর নির্যাতন। বীরভূমে অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। রক্ষকই সেখানে ভক্ষকের ভূমিকায়। হুগলিতে সেই রক্ষককেই অসহায় দেখা গেল দুষ্কৃতীদের সামনে।
সোমবার চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগরে দুষ্কৃতীদের হাতে মার খেলেন তৃণমূল পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যা রুমা সরকার। শুধু মারধর করেই রেহাই দেয়নি তারা। হুমকি দিয়ে শূন্যে গুলি চালাতে চালাতে গা-ঢাকা দেয় টোটন নামে ওই দুষ্কৃতী আর তার দলবল। যেখানে ঘটনা ঘটেছে সেখান থেকে জেলার পুলিশ সুপার, জেলাশাসক আর প্রশাসনের কর্তাদের আবাসনের দূরত্ব খুব বেশি নয়। পুলিশ অবশ্য সোমবার রাত পর্যন্ত টোটনের খোঁজ পায়নি। আর এখানেই প্রশ্ন তুলেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের বক্তব্য, খোদ শাসক দলের এক নেত্রীরই যখন এমন অবস্থা, তখন তাঁরা আর কার ওপর ভরসা করবেন? স্পষ্টতই পুলিশের ভূমিকা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
যদিও দিনভর শাসক দলের জেলার হোমরা-চোমড়া নেতারা পুলিশ কর্তাদের কাছে ঘেরাফেরা করেছেন। দাবি তুলেছেন দুষ্কৃতীদের ধরার জনা। কিন্তু পুলিশের সাফ জবাব,‘সাপের ঘরে ঘোগের বাসা’। খোদ প্রশাসনের কর্তারাই ‘তির’ ঘুরিয়ে দিয়েছেন শাসকদলের দিকে। সোমবার রাতে পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানান, প্রশাসনের কাছে সব খবর আছে। দুষ্কৃতী নিয়ে শাসকদলের যখন মাথাব্যাথা বেশি হয় তখন পুলিশের কাজের গুরুত্ব বেড়ে যায়।
প্রশাসন সূত্রের খবর, সোমবার রাতে হুগলি-মগরা পঞ্চায়েত সমিতির সদস্যা রুমা সরকারের বাড়িতে হানা দেয় টোটন ও তার দলবল। মদ্যপ অবস্থায় কথা কাটাকাটির পরই ওই পঞ্চায়েত সদস্যাকে চড়-থাপ্পড় মারতে শুরু করে তারা। ভয় পেয়ে রুমাদেবীর স্বামী গৌতম সরকারের নাম ধরে ডাকতে শুরু করেন। সেই সময় রাতের খাওয়া সারছিলেন তিনি। স্ত্রীর চিত্কার শুনে বাইরে এলে তাঁকেও মারধর শুরু করে দুষ্কৃতীরা। টোটনকে দেখে চিনতে পেরে রুমাদেবী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাদের পাপইগানের মুখ থেকে স্বামীকে বাঁচাতে গেলে আরও মার খানা তিনি। গৌতমবাবু বলেন, “স্থানীয় কংগ্রেস কর্মী মানিক দাসের নাম করে চিত্কার করে ওরা জানতে চায় কেন কথা বলি ওঁর সঙ্গে। কেন কথা বলব না জানতে চাইলে ফের মারধর করে।”
তদন্তকারী এক পুলিশ অফিসার বলেন,“সাধারণভাবে দুষ্কৃতী-তোলাবাজরা সাধারণ মানুষের থেকে টাকা চায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তদন্ত করে দেখা গিয়েছে উল্টো ছবি।” তাঁর কথায়, “তোলাবাজিতে যাতে কোনও বাধা না আসে সে জন্য টোটন ও তার দলবল ওই নেত্রীর উপরে চাপ দেয়। সম্ভবত তিনি রাজি না হওয়াতেই এই হামলা।” তবে এ জন্যই না কি অন্য কোনও কারণে এই হামলা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
স্থানীয় সূত্রের খবর, ওই পঞ্চায়েত সদস্যা এবং তাঁর স্বামীর এলাকায় সুনাম আছে। তাঁরা রীতিমত ছাপোষা পরিবার। কেন হঠাত্ দুষ্কৃতীরা তাঁদের বাড়িতেই চড়াও হল, দিনভর সেই প্রশ্নই ঘুরপাক খেয়েছে এলাকায়। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) কোটেশ্বর রাও বলেন, “ওই দুষ্কৃতী ও তার দলবলকে ধরতে তল্লাশি চলছে।”
পুলিশ তল্লাশি করে টোটনকে পাবে কি না তা সময়ই বলবে। কিন্তু জেলা সদর চুঁচুড়া স্টেশন রোড, রবীন্দ্রনগর, হুগলি স্টেশন এলাকায় প্রমোটারি এবং তোলাবাজিতে সাধারণ মানুষ থেকে ব্যবসায়ীরা নাজেহাল। স্থানীয় এক প্রবীণ শিক্ষক বলেন, “সিপিএম আমলেও তোলাবাজি মস্তানি দেখেছি। কিন্তু মস্তানরা দলের ঊর্ধ্বে ছিল না। সিপিএম নেতারা তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। কিন্তু বর্তমান তৃণমূল নেতাদেরই মাথায় চড়ে গিয়েছে দুষ্কৃতীরা।” চুঁচুড়ার বিধায়ক তপন মজুমদার বলেন, “আমি অসুস্থ শরীর নিয়েই দুষ্কৃতীদের গ্রেফতারের দাবিতে পুলিশ লাইনে কর্তাদের কাছে গিয়েছিলাম। এটা ঘটনা, চুঁচুড়া শহরে মদ, জুয়া, সাট্টা বেড়েছে। মস্তানি চলছে। এ সব সহ্য করা যায় না।”
কিন্তু নিজের দল, তৃণমূলের সঙ্গে মস্তানদের মাখামাখি? পুলিশ তো ইঙ্গিত দিচ্ছে সেই দিকেই। এ বার বিধায়ক অনেকটাই রক্ষণাত্মক। বললেন, “আমার এ সব জানা নেই। তবে খবর পেলেই দলের নেত্রীকে সরাসরি বলব। আর দলের মধ্যে তো বলবই।” তাঁর দাবি, “পুলিশ সুপারকে বলেছি, কোনও দল দেখতে হবে না। আগে গ্রেফতার করুন টোটনকে। কেউ দল দেখালে, সরাসরি আমাকে বলুন। আমি তার উচিত শিক্ষা দেব।”
দলের সভাপতি উচিত শিক্ষা দিতে পারেন কি না তা সময়ই বলবে।