পুনরুজ্জীবনের অপেক্ষায়। শ্রীরামপুরে বন্ধ স্পিনিং মিল (বাঁদিকে), ডানদিকে, ডানলপ কারখানা।
আর ক’দিন বাদেই পুজো। কিন্তু এ বারও হুগলি শিল্পাঞ্চলের বন্ধ কারখানার শ্রমিকদের হাহুতাশে কোনও আশ্বাস মেলেনি।
উন্নয়নের স্বার্থে বিভিন্ন সভা-সমাবেশে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায়ই ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে জোর দেওয়ার কথা বলেন। কিন্তু হুগলির ডানকুনি থেকে শুরু করে উত্তরপাড়া, হিন্দমোটর, রিষড়া, শ্রীরামপুর হয়ে চুঁচুড়া-ব্যান্ডেল-ত্রিবেণী পর্যন্ত বিস্তীণর্র্ শিল্পাঞ্চলে গত দু’দশকে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পুনরুজ্জীবনের উদ্যোগ কই? সে ভাবে গড়ে ওঠেনি কোনও নতুন শিল্পও। এই জেলারই সিঙ্গুর থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে গিয়েছে টাটাদের মোটরগাড়ি কারখানা। ফলে, হুগলি শিল্পাঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু চেহারা বিশেষ পাল্টায়নি।
জেলার বড় শিল্পগুলির মধ্যে প্রথম সারিতেই ছিল উত্তরপাড়ার হিন্দুস্তান মোটরস কারখানা এবং সাহাগঞ্জের ডানলপ। দীর্ঘদিন ধরে খুঁড়িয়ে চলতে চলতে মোটরগাড়ি তৈরির কারখানাটিতে কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে গত মার্চের শেষ দিকে। একের পর এক বৈঠকেও মিটছে না সমস্যা। অন্য দিকে, ২০১২ সালে শেষ বারের মতো বন্ধ হয়ে যাওয়া সাহাগঞ্জের ডানলপ কারখানা সম্প্রতি খোলার ইঙ্গিত দিয়েছেন সংস্থার কর্ণধার পবন রুইয়া। কিন্তু শ্রমিকেরা আশার আলো দেখছেন না।
এর বাইরে বর্তমানে হুগলি শিল্পাঞ্চলে বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প-কারখানার সংখ্যা অন্তত একশো। স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে ওই সব কারখানায় কাজ করতেন অন্তত ২০ হাজার শ্রমিক। কাজ হারিয়ে এখন তাঁদের কেউ রিকশা চালান। কেউ দিনমজুরি করেন। কেউ বা বেছে নিয়েছেন অন্য কোনও কাজ। প্রত্যেকেরই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। অথচ, কারখানা থেকে তাঁদের কারও বকেয়া রয়েছে তিন লক্ষ, কারও এক বা দু’লক্ষ টাকা। অভাবের সংসারে তাই পুজোর আনন্দ সে ভাবে উঁকি দেয় না।
শ্রীরামপুরের তারাপুকুর কলোনির বাসিন্দা নিতাই নাগ যেমন। শ্রীরামপুরেই একটি ঢালাই কারখানায় ১৩ বছর কাজ করেছেন। ১৯৯৩ সালে শ্রমিক অসন্তোষের জেরে সেই কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। নিতাইবাবু এখন মাছ বিক্রি করেন। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক লক্ষ টাকা পাওনা রয়েছে। সে টাকা বোধহয় আর পাব না। পুজোর আনন্দ নিয়ে আর ভাবি না।” রিষড়ার জে কে স্টিলে টানা ২৫ বছর কাজ করেছেন রামকৃষ্ণ কর্মকার। প্রায় দু’দশক আগে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তার পর থেকে খৈনি, পান-বিড়ির একটি গুমটিই তাঁর সম্বল। তিনিও বলেন, “গ্র্যাচুইটি পাইনি। ছেলেকে পড়াতে পারিনি। চোখের সামনে ওই রকম একটা কারখানা শ্মশান হয়ে গেল। পুজোয় আর কী করব!’’ ওই কারখানাতেই বহু বছর কাজ করে আজ কার্যত বেকার সুবলচন্দ্র দাস। মেয়ের টিউশনির টাকায় তাঁর সংসার চলে। কারখানার পাওনাগণ্ডা তাঁর জোটেনি।
গত তিন বছরের মতোই এ বারেও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে পুজো কাটাবে শ্রীরামপুরের সিমলায় রাজ্য সরকারের পরিচালনাধীন কো-অপারেটিভ স্পিনিং মিলের শ্রমিকদের। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সেখানে উৎপাদন বন্ধ। সরকার গালভরা আশ্বাস দিলেও পুনরুজ্জীবন কবে হবে, বলতে পারছেন না কেউ। ডানকুনির একটি কারখানায় প্রায় পাঁচ মাস ধরে ‘লে-অফ’ (বিশেষ পরিস্থিতিতে উৎপাদন বন্ধ। শ্রমিকরা হাজিরা দিলে বেতনের অর্ধেক টাকা পাচ্ছেন) চলছে। জেলার ১১টি জুটমিলই কোনও রকমে তাঁদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে। এমন উদাহরণ আরও রয়েছে।
জেলার বন্ধ হয়ে যাওয়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের শ্রমিকদের দুরবস্থার কথা শ্রম দফতরের অফিসাররা অস্বীকার করছেন না। যদিও তাঁদের দাবি, গত কয়েক বছরে অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি চালু হয়েছে। বন্ধ কারখানার কয়েক হাজার শ্রমিক ‘ফাওলাই’ (ফিনান্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স টু দ্য ওয়ার্কার্স অব লকড্ আউট ইনডাস্ট্রিজ) প্রকল্পে মাসে দেড় হাজার টাকা করে পাচ্ছেন।
দু’বছর আগে ডানকুনিতে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানা হয়েছে। কিন্তু তার পরে অবশ্য তেমন কোনও নতুন শিল্প এ তল্লাটে দেখাতে পারছেন না শ্রমকর্তারা। বন্ধ হয়ে যাওয়া বা ধুঁকতে থাকা শিল্প-কারখানাগুলির পুনরুজ্জীবনেও সরকারি তরফে তেমন প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ শ্রমিকদের। শ্রম দফতরের পরিষদীয় সচিব তপন দাশগুপ্ত অবশ্য সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন। তাঁর দাবি, “বাম জমানায় একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়েছে। চমক দিতে বহু ক্ষেত্রে শুধু শিলান্যাস হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শিল্পের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছেন। হুগলিতে সবক’টি জুটমিল খোলা রয়েছে। ডানলপ-হিন্দমোটর নিয়ে আলোচনা চলছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলির পুনরুজ্জীবনেও জোর দেওয়া হচ্ছে।”
শ্রমিকেরা অবশ্য বলছেন, না আঁচালে বিশ্বাস নেই। কারণ পরিস্থিতি জটিল।
(চলবে)