প্রশাসনের ‘বঞ্চনা’র জবাবে নিজেরাই খাল সংস্কারে নামলেন গ্রামবাসীরা

এ এক অন্য মিছিল! কোনও জনসভার উদ্দেশে নয়। সকাল থেকে দল বেঁধে গ্রামবাসীরা চলেছেন পূবের খালের দিকে। সকলেরই হাতে কাস্তে, কোদাল। চলেছেন তাঁরা খাল সংস্কার করতে। কারণ এই খালের উপরেই নির্ভর করছে তাঁদের রুটি-রুজি। সামনেই বোরোচাষের মরসুম। জলের খুবই দরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়া মজা খালে জল আসবে কী ভাবে?

Advertisement

নুরুল আবসার

আমতা শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:২৮
Share:

আমতার মুক্তিরচক গ্রামে খাল সংস্কার করছেন গ্রামবাসীরা। ছবি: সুব্রত জানা।

এ এক অন্য মিছিল!

Advertisement

কোনও জনসভার উদ্দেশে নয়। সকাল থেকে দল বেঁধে গ্রামবাসীরা চলেছেন পূবের খালের দিকে। সকলেরই হাতে কাস্তে, কোদাল। চলেছেন তাঁরা খাল সংস্কার করতে। কারণ এই খালের উপরেই নির্ভর করছে তাঁদের রুটি-রুজি। সামনেই বোরোচাষের মরসুম। জলের খুবই দরকার। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার না হওয়া মজা খালে জল আসবে কী ভাবে? খাল সংস্কারের জন্য পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ব্লক প্রশাসন, সকলের দোরে ঘুরেছেন এলাকার মানুষ। কিন্তু কেউই খাল সংস্কার নিয়ে মাথা ঘামাতে চাননি বলে অভিযোগ তাঁদের। অথচ জল না এলে হাজার হাজার বিঘা জমিতে হবে না চাষ।

সরকারের দোরে ঘুরে হতাশ এলাকার চাষিরা ঠিক করে ফেলেন আর প্রশাসনের দোরে নয়, নয় প্রতিবাদ জানিয়ে বিক্ষোভ-অবরোধ। এ বার তাঁরা নিজেরাই নামবেন খাল সংস্কারে। স্বেচ্ছাশ্রমের এই ভাবনাকে আশ্রয় করেই শুক্রবার আমতার মুক্তিরচক গ্রামের মানুষ নেমে পড়েছিলেন খাল সংস্কারে।

Advertisement

হুগলি নদী থেকে বেরিয়েছে বনস্পতি খাল। তা থেকে আবার বেরিয়েছে পূবের খাল। গ্রামের বুক চিরে সাপের মতো এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ খালটি। হুগলি নদীর জোয়ারের জল আসে বনস্পতি খালে। সেই জল পূবের খাল দিয়ে মুক্তিরচকের জমি ভাসিয়ে দিত। যাতে ফসল ফলতো মাঠে। কিন্তু দু’বছর ধরে সংস্কারের অভাবে খালের জীর্ণ দশা। আগের মতো জল আসে না। আবর্জনা, পানা এবং জঙ্গলে খালের অস্তিত্বই মুছে যাওয়ার জোগাড়। জলের অভাবে খালের দু’পাশের জমি ফুটিফাটা হতে শুরু করেছে। তবে আর তা নিয়ে আগের মতো চিন্তিত নন চাষিরা। কারণ, তাঁরা জানান, সংস্কার হয়ে গেলেই খালে জল ঢোকার বাধা থাকবে না। হগলি নদীর জোয়ারের জল এ বার অনায়াসে চলে আসবে। সেই জলেই শুরু হবে চারা রোপণ।

অপলা গায়েন নামে এক গ্রামবাসী বলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে ব্লক প্রশাসন, সর্বত্রই এই খাল সংস্কার করার জন্য দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। তাই আমরা সকলে সিদ্ধান্ত নিই, নিজেরাই খাল সংস্কার করব। প্রত্যেককেই স্বেচ্ছাশ্রম দেওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। সেইমতো কয়েকিদিন ধরে ঢেঁড়া পিটিয়ে গ্রামবাসীদের এ কথা জানিয়ে দেওয়া হয়। তারপরেই এ দিন কাজ শুরু করি।”

শুক্রবার সকাল থেকেই দলে দলে গ্রামবাসী এসে খাল সংস্কারের কাজে নেমে পড়েন। এ দিন মোট সাড়ে তিনশো গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রম দিয়েছেন বলে অন্যতম উদ্যোক্তা অশোক মণ্ডল জানান। এখন কয়েকদিন টানা কাজ চলবে বলে গ্রামবাসীরা জানান।

তাঁদের দাবি নিয়ে প্রশাসনের মাথা না ঘামানোর প্রসঙ্গে গ্রামবাসীদের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাতেই এমন অবস্থা। গ্রামটি আমতা গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীন। পঞ্চায়েত তৃণমূলের দখলে। কিন্তু মুক্তিরচক গ্রামে রয়েছে সিপিএমের প্রভাব। এখান থেকে নির্বাচিত দু’জন পঞ্চায়েত সদস্যই সিপিএম সমর্থিত নির্দল। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এলাকাটি সিপিএম অধ্যুষিত বলেই ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকে কোনও উন্নয়নমূলক কাজ হয়নি। অপলাবাবু ও অশোকবাবুর কথায়, “এর আগে সিপিএম এই গ্রাম পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় ছিল। তখন ১০০ দিনের কাজের প্রকল্পে নিয়মিত খাল সংস্কার হত। কিন্তু গত দু’বছর কিছুই হয়নি।” এলাকার অন্যতম পঞ্চায়েত সদস্য নবকুমার পাত্র বলেন, “আমি নিজে বহুবার এই খাল সংস্কার করার জন্য ব্লকে এবং গ্রাম পঞ্চায়েতে গিয়েছি। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।” নববাবু নিজেও হাত লাগিয়েছেন সংস্কারের কাজে।

খাল সংস্কার না হওয়ার বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেননি তৃণমূল শাসিত আমতা ১ পঞ্চায়েত সমিতির কর্তারা। তবে তাঁদের বক্তব্য, ওই গ্রামে উন্নয়নের কাজে কিছু সমস্যা রয়েছে। সমিতির সহ সভাপতি শুকদেব মণ্ডল বলেন, “ওই গ্রামে ১০০ দিনের কাজ করতে গিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির কয়েকজন কর্মাধ্যক্ষকে গ্রামবাসীরা বেধড়ক মারধর করেন। এ বছর ১০০ দিনের কাজে আট লক্ষ টাকার প্রকল্প নেওয়া হয় প্রাণিসম্পদ বিকাশ দফতরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে। গ্রামবাসীরা তা-ও করতে দেননি। গ্রামের জবকার্ডধারীরা কাজ করতে রাজি হননি। অন্য গ্রাম পঞ্চায়েতে সিপিএম এলাকায় আমরা প্রচুর কাজ করেছি। আসলে এই গ্রামের নিজস্ব কিছু সমস্যা রয়েছে।”

এ ব্যাপারে নববাবু, অপলাবাবুরা বলেন, “গত বছর এলাকার পঞ্চায়েত সদস্যদের না জানিয়ে নিজেদের ইচ্ছামতো পঞ্চায়েত সমিতি একশো দিনের প্রকল্পে কাজ করাতে গিয়েছিল। ফলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে বিবাদ বাধে। গ্রামবাসীদের পুলিশ দিয়ে পেটানো হয়। এ বার ৮ লক্ষ টাকার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ঠিকই। চাষের গরুর বিশ্রামের ছাউনি করার কথা হয়। কিন্তু আমাদের দাবি ছিল খাল সংস্কারের কাজ আগে করতে হবে। এর পরেই পঞ্চায়েত সমিতি পিছিয়ে যায়।”

গ্রামের লোকের স্বেচ্ছাশ্রমে খাল সংস্কার নিয়ে অশোকবাবু বলেন, “ব্লক অফিস ঘেরাও, বা পঞ্চায়েত অফিস ঘেরাও না করে আমরা কাজের মাধ্যমে আমাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছি।” তাঁর দাবি, প্রশাসন রাজনীতি করলেও তাঁরা দলমত নির্বিশেষে সব গ্রামবাসীকেই ডেকেছেন কাল সংস্কারে। কারণ মাঠে তো আর শুধু সিপিএমের লোকের জমি নেই। তবে তৃণমূলের লোকজন আসেননি। এ বিষয়ে তৃণমূল নেতাদের বক্তব্য, গ্রামে তাঁদের দলের সমর্থক খুব বেশি নেই। যাঁরা নেতৃত্বে ছিলেন তাঁরাও মুক্তিরচক গণধর্ষণ মামলায় জড়িয়ে গ্রামছাড়া। সিপিএমই এখানে গ্রামবাসীদের বকলমে যা খুশি তাই করছে।

এ দিন অবশ্য গ্রামে গিয়ে দেখা গেল মহানন্দে খাল সংস্কারে নেমে পড়েছেন গ্রামের মানুষ। ঝপাঝপ কোদালের কোপ পড়ছে মজা খালের বুকে। তুলে ফেললা হচ্ছে পানা, ঝোপঝাড়। কোদাল চালাতে চালাতেই ভদ্রেশ্বর গায়েন, অরবিন্দ গায়েন বলে ওঠেন, “বঞ্চনার জবাব আমরা এ ভাবেই দিতে চাই।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন