নায়েবি ঠাটবাট আর নেই। নেই কামানের গর্জন। হারাতে বসেছে আগের মতো সকলে পাত পেড়ে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়ার অতীত। তবে, অনেক ‘নেই’-এর মধ্যেও তারকেশ্বরের কেশবচক গ্রামের পাল পরিবারের দুর্গাপুজোয় সাবেকিয়ানাই যেন শেষ কথা। কুমারী পুজো হয়। গ্রামের মহিলারা এসে সিঁদুর খেলেন। পুজোয় ফুটবল নিয়ে ধুন্ধুমার লড়াইয়ের আয়োজন হয়।
প্রায় একশো বছর আগে শৈবতীর্থ তারকেশ্বরের কেশবচকে পাল পরিবারে দুর্গাপুজো শুরু হয়। তত্কালীন কর্তা কুঞ্জ পালের হাত ধরে। তিনি ছিলেন দশঘড়ার জমিদারের নায়েব। তখন এ তল্লাটে দুর্গাপুজোর চল বড় একটা ছিল না। সেই কারণেই দেবীর পুজো করবেন বলে মনস্থির করেন কুঞ্জবাবু। পারিবারিক রীতি মেনে জন্মাষ্টমীর দিন কাছের দামোদরের তীর থেকে মায়ের নামে মাটি তুলে আনা হয়। সেই মাটিতেই গড়া হয় প্রতিমা। পুজো ঢাকে কাঠি পড়ে পঞ্চমীতে।
প্রথম দিকে পুজো হত তালপাতার আটচালায়। পরে ১৩৫১ সালে পরিবারের কর্তা মদনমোহন পাল তালপাতার আটচালার পরিবর্তে ইটের দেওয়াল এবং অ্যাসবেসটসের ছাউনি দেওয়া ঠাকুর দালান তৈরি করেন। পরিবার সূত্রেই জানা গেল, তাঁর সময় থেকেই পুজোটি অন্য মাত্রা পেয়েছিল। পরিবারের গণ্ডী ছাড়িয়ে পুজো হয়ে উঠেছিল গ্রামের সকলের। পুজো উপলক্ষে গ্রামের সকলের নিমন্ত্রণ থাকত পাল বাড়িতে। দশমীতে খিচুরি, পাঁচ রকম ভাজা, পায়েস, মিষ্টি রান্না হত। বাইরের নয়, পারিবারিক রাধুনিই সব রান্নাবান্না করতেন। কয়েক বছর আগে অবশ্য জীর্ণ হয়ে পড়া ঠাকুর দালানের পরিবর্তে ঝাঁ চকচকে ঠাকুর দালান তৈরি হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় বারোয়ারি পুজোর রমরমা বেড়েছে। আর তার জেরে পারিবারিক এই পুজোর জৌলুস কমলেও ঐতিহ্য আজও অম্লান। আজও দশমীতে গ্রামের মানুষের নিমন্ত্রণ থাকে এই বাড়িতে। পরিবারের বর্তমান কর্তা রতিশরঞ্জন পাল বলেন, ‘‘সে যুগ আর এ যুগের পরিবর্তন হয়েছে অনেকটাই, তবে আমরা পুরনো দিনের রীতিনীতি যতটা পারা যায় বজায় রাখার চেষ্টা করি।’’
আজও এই বাড়িতে একচালার প্রতিমা পুজো হয়। নবমীতে কুমারী পুজো হয়। ওই দিন গ্রামের বিবাহিত এবং অবিবাহিত পুরুষদের মধ্যে ফুটবল খেলা হয়। গ্রামের মানুষ এই খেলাকে মজা করে বলেন, ‘বিয়ালি-শিয়ালি’র লড়াই। দশমীতে বিসর্জনের আগে সিঁদুর খেলাতেও পরিবারের মেয়েদের পাশাপাশি মেতে ওঠেন গ্রামের মহিলারা। পরিবারের সদস্যরা জানালেন, দশমীতে গ্রামবাসীদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানোর রেওয়াজ অনেক দিন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এ বার অবশ্য পুরনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে একাদশীতে গ্রামবাসীদের খাওয়ানোর আয়োজন করা হচ্ছে।
পাল বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতেই জানা গেল, এক সময়ে যথেষ্ট জমিদারি ঠাটবাট ছিল এই পরিবারে। কুঞ্জ পাল হাতির পিঠে চড়ে নায়েবি করতেন। মদনমোহনবাবুর আমলে পুজোর চার দিন সূর্যাস্তের পরে কামান দাগা হত। এখন সে সব অতীত।
তবে অনেক না থাকার মধ্যেও সবুজ ধানখেতে ঘেরা কেশবচকের এই পরিবারের পুজোর প্রতি ভালবাসায়, ভক্তিতে ভাটা পড়েনি গ্রামবাসীদের।
—নিজস্ব চিত্র।