জাঙ্গিপাড়ায় দীপঙ্কর দে’র তোলা ছবি।
সংস্কারের অভাবে ফি-বছর বর্ষায় ডাকাতিয়া খাল উপচে প্লাবিত হয় হুগলি এবং হাওড়া জেলার অন্তত ২৮টি মৌজার বহু কৃষিজমি। এ বার সেই খালের ভাগ্য ফেরাতে অবশেষে কোমর বেঁধে নামার সিদ্ধান্ত নিল রাজ্যের সেচ দফতর। বর্ষা কেটে গেলেই দুই জেলায় ওই খালের পূর্ণাঙ্গ সংস্কারের কাজে হাত দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়।
সোমবার বিধাননগরে জলসম্পদ ভবনে ডাকাতিয়া খালের সংস্কার নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের প্রশাসনিক বৈঠক হয়। সেখানে সেচমন্ত্রী ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন কৃষি প্রতিমন্ত্রী বেচারাম মান্না, উদয়নারায়ণপুরের বিধায়ক সমীর পাঁজা, হুগলি জেলা পরিষদের সভাধিপতি মেহবুব রহমান, উপাধ্যক্ষ সমীরণ মিত্র এবং সরকারি আধিকারিকরা।
সেচমন্ত্রী বলেন, ‘‘সার্বিক ভাবেই নিম্ন দামোদর সংস্কারের একটা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গেই ডাকাতিয়া খাল সংস্কার করা হবে।” বেচারামবাবু জানিয়েছেন, এ বার আর ডাকাতিয়া খালের জন্য মানুষের সমস্যা হবে না। তাঁদের উপকার হবে।
বর্ধমানের জামালপুর থেকে ডাকাতিয়া খালটি শুরু হয়ে হুগলির ধনেখালি, তারকেশ্বর, হরিপাল, জাঙ্গিপাড়ার উপর দিয়ে গিয়ে হাওড়ার আমতায় মাদারিয়া খালে মিশেছে। বহু দিন খালটির পূর্ণাঙ্গ সংস্কার হয়নি। ফলে, বেশ কিছু জায়গায় খালটি কার্যত মজে গিয়েছে। কোথাও সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে, কোনও অংশে কচুরিপানা বা আগাছায় ভরে খাল তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। ঠিকঠাক বাঁধ মেরামত করা হয়নি। অথচ, ওই সব এলাকার নিকাশি ব্যবস্থা এই খালের উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু সংস্কারের অভাবে সেই খালই এখন ফি-বছর গ্রামবাসীদের দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওই খালের দু’ধারে চাষাবাদ হয়। খাল উপচে তারকেশ্বরের ২টি, হরিপালের ১২টি, জাঙ্গিপাড়ার ৮টি এবং হাওড়ার ৬টি মৌজা জলমগ্ন হয়। প্রায় ২০০ হেক্টর জমির চাষ নষ্ট হয়। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, শুধু চাষাবাদই নষ্ট হয় না, গ্রামেও জল ঢোকে। গুরুত্বপূর্ণ খালটি সংস্কারের ব্যাপারে প্রশাসন আশ্বাস দিলেও এত দিনেও কাজের কাজ কিছু হয়নি।
সেচ দফতর সূত্রের খবর, সোমবারের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে ১) খালটি আমূল সংস্কার করা হবে। ২) হরিপালের পশ্চিম গোপীনাথপুর থেকে জাঙ্গিপাড়ায় ধনপোঁতা সেতুর আগে পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার অংশে ‘ইনস্পেকশন বাঁধ’ তৈরি করা হবে। এ ব্যাপার সেচ দফতরের ইঞ্জিনিয়ারদের প্রকল্প তৈরি করতে বলা হয়েছে। ৩) হরিপালে ৩১ নম্বর রুটের উপর খাজুরিয়া সেতু ২০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৫০ মিটার চওড়া করা হবে। একই ভাবে দুই জেলার মধ্যে সংযোগকারী ধনপোতা সেতুও সংস্কার করা হবে। জাঙ্গিপাড়ার ভীমপুর এবং অমরপুরের মধ্যে সংযোগকারী ফুটব্রিজও চওড়ায় বাড়ানো হবে। ৪) সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য ডাকাতিয়া খালকে রনের খাল এবং মাদারিয়া খালের সঙ্গে প্রশস্ত ভাবে যুক্ত করতে হুগলিতে ১৪ হেক্টর এবং হাওড়ায় ৭ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন। চাষিদের বুঝিয়ে সেই জমি হাতে নেওয়ার চেষ্টাও করা হবে।
সেচমন্ত্রীর কথায়, ‘‘পূর্বতন সরকারের আমলে সেচ দফতরের অনুমতি ছাড়াই জাঙ্গিপাড়ার ফুটব্রিজটি তৈরি হয়েছিল। পরিকল্পনাবিহীন ভাবে তৈরি সংকীর্ণ ওই সেতুর জন্য খালটির অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।”
প্রশাসন সূত্রের খবর, সত্তরের দশকে রাজ্যের তৎকালীন সেচমন্ত্রী গনি খান চৌধুরীর আমলে ডাকাতিয়ার সংস্কারের কাজ শুরু হয়। কিন্তু জামালপুর থেকে ৭৪ কিলোমিটার কাজ হওয়ার পরে হুগলি-হাওড়ার সীমানায় জমি-জটে সেই কাজ আটকে যায়। পরে বিতর্ক মিটলেও পূর্ণাঙ্গ সংস্কার আর হয়নি। সংস্কারের দাবিতে বহু আন্দোলন হলেও কাজের কাজ হয়নি গত চার দশকে। তাই প্রতি বছর ডিভিসি জল ছাড়লে বা অতিবৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়াটাই দস্তুর। ইনস্পেকশন’ বাঁধের কাজ না হওয়ায় বাঁধের উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব হয় না। বর্তমান সরকারের আমলে বেচারামবাবুর উদ্যোগে জাঙ্গিপাড়ায় খালের কিছুটা অংশ সংস্কার হলেও সমস্যা মেটেনি।
চলতি বর্ষার মরসুমের গোড়ায় হরিপালে এই খালের একটি জায়গায় বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢোকে। তাতে বেশ কয়েক হেক্টর চাষের জমি ডুবে যায়। সেচ দফতর বালির বাঁধ দিয়ে পরিস্থিতি কোনও রকমে সামাল দেয়। এ বার অবশ্য পরিকল্পনামাফিক কাজ হলে পরিস্থিতি বদলাবে বলে মনে করছেন গ্রামবাসীদের অনেকেই।
সোমবারের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন হরিপালের কৃষক শেখ সইফুদ্দিন, আব্দুল গনি এবং আব্দুল কালাম আজাদ। তাঁরাও আশা করছেন, এ বার ডাকাতিয়ার সমস্যা মিটবে। আর জলে ডুববে না গ্রাম। বাঁচবে খেতের ফসল।