ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মোমবাতির কারিগর, মিলল প্রতিবন্ধকতাকে জয়ের স্বীকৃতি

ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মোমবাতি তৈরির কারিগর—জীবনের এমন পট পরিবর্তন ঘটবে তা কল্পনাতেও আনতে পারেননি শ্রীরামপুরের চেশায়ার হোমের আবাসিক প্রদীপ মণ্ডল। জন্মাবধি বিকলাঙ্গ। কুণ্ডলী পাকিয়ে যাওয়া শরীরটার আকৃতি ফুট দুয়েকের বেশি নয়। ওই শরীর নিয়ে কখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন, নিজেও তা বিশ্বাস করতেন না। অগত্যা বেঁচে থাকতে ভিক্ষাবৃত্তিকে অবলম্বন করেছিলেন। বছর বাইশ সে ভাবেই কেটেছে। পরে ঠাঁই হয় হোমে।

Advertisement

প্রকাশ পাল

শ্রীরামপুর শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২৭
Share:

মোমবাতি তৈরিতে ব্যস্ত প্রদীপ।—নিজস্ব চিত্র।

ভিক্ষাবৃত্তি থেকে মোমবাতি তৈরির কারিগর—জীবনের এমন পট পরিবর্তন ঘটবে তা কল্পনাতেও আনতে পারেননি শ্রীরামপুরের চেশায়ার হোমের আবাসিক প্রদীপ মণ্ডল। জন্মাবধি বিকলাঙ্গ। কুণ্ডলী পাকিয়ে যাওয়া শরীরটার আকৃতি ফুট দুয়েকের বেশি নয়। ওই শরীর নিয়ে কখনও নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবেন, নিজেও তা বিশ্বাস করতেন না। অগত্যা বেঁচে থাকতে ভিক্ষাবৃত্তিকে অবলম্বন করেছিলেন। বছর বাইশ সে ভাবেই কেটেছে। পরে ঠাঁই হয় হোমে। সেখানেই শুরু হয় প্রতিবন্ধকতাকে জয় করার লড়াই।

Advertisement

আর এক জনের শরীরে বাসা বেঁধেছে ব্লাড ক্যানসার। কিডনির অসুখও (রেনাল ফেলিওর) থাবা বসিয়েছে শরীরে। এমন অবস্থাতেও উত্তরপাড়ার বাসিন্দা মলয় সেন মনের তাগিদে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবন্ধীদের জন্য অধিকার বুঝে নিতে। বুধবার বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে রবীন্দ্র সদনে তাঁদের এই লড়াইকে স্বাগত জানিয়ে দু’জনের হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি।

বছর আঁটত্রিশের প্রদীপের জন্ম উত্তর ২৪ পরগনার ভাটপাড়ায়। জন্মাবধি বিকলাঙ্গ। কিশোর বয়সে মা মারা যেতে অথৈ জলে পড়েন। বেঁচে থাকার তাগিদে ব্যারাকপুরের চন্দনপুকুর বাজারে ভিক্ষা করতে শুরু করেন। কয়েক বছর পর সেখান থেকে এক ব্যক্তির হাত ধরে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেও ভিক্ষাবৃত্তি থামেনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮ সালে শ্রীরামপুরের এই হোমে আসেন। শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়েও আর পাঁচজনের লড়াই দেখে উদ্বুদ্ধ হন। প্রদীপ বলেন, “বছর দশেক আগে হোমেই তৎকালীন সিস্টার ইন-চার্জের আগ্রহে মোমবাতি তৈরি করতে শিখি।” হোমে ফিজিওথেরাপি করান গৌর ঘোষ। তিনি জানান, ১০০ শতাংশ প্রতিবন্ধী প্রদীপের রোগের পোষাকি নাম ‘অস্টিওপ্রোসিস’। অস্থির গঠন অস্বাভাবিক। হুইল চেয়ার ঠেলে নিয়ে যেতে হয়। হাড়ে জোর না থাকায় একটু অসাবধান হলেই চোট লেগে যায়। হাত-পা নাড়তেও বেশ কষ্ট হয়। যখন এসেছিল তখন কিছুই করতে পারত না। আর এখন মোমবাতি তৈরিতে রীতিমতো দক্ষ হয়ে উঠেছেন প্রদীপ। তাঁর তৈরি বাহারি মোমবাতির কদর রয়েছে যথেষ্ট।

Advertisement

হোমের সবচেয়ে পুরনো আবাসিক শুভ্রেন্দু নাগের জীবনও হুইল চেয়ারে আবদ্ধ। বছর চল্লিশ আগে আঁকায় দক্ষতার জন্য তিনিও পুরস্কার পান। হোমের পুরনো কর্মী এবং আবাসিকদের সর্বক্ষণের সঙ্গী কার্তিক জানার কথায়, “যখন দেখি এঁরা পুরস্কার পাচ্ছে খুব আনন্দ হয়। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই, ভাল লাগে যখন দেখি ওঁরা যাবতীয় প্রতিবন্ধকতাকে হারিয়ে দিয়ে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছেন।”

বাংলায় এমএ মলয়বাবু ১৯৯৭ সাল থেকে প্রতিবন্ধীদের পুনরুজ্জীবন এবং তাঁদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসার জন্য লড়াই করে চলেছেন একটি স্বেচ্ছ্বাসেবী সংগঠননের হয়ে। দৃষ্টিহীন, বিকলাঙ্গ থেকে মূক-বধির সকলেই বদ্ধ জীবন থেকে মুক্ত হয়ে সমাজের মূল ধারায় সামিল হওয়ার রাস্তা খুঁজতে ভরসা করেন এই প্রৌঢ়ের উপর। চেষ্টার ত্রুটি নেই মলয়বাবুরও। ২০০৯ থেকে অবশ্য আরও একটি লড়াই লড়ছেন তিনি। ওই বছরই ব্লাড ক্যানসার আর কিডনির রোগ ধরা পড়ে তাঁর। কিন্তু মারণ রোগ তাঁকে প্রতিবন্ধীদের জন্য লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরাতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই হাসপাতালে যেতে হয়। কিন্তু সেখানেও মোবাইল, ল্যাপটপে কাজ চলে তাঁর।

এ দিন স্ত্রী রূপালিদেবীকে নিয়ে পুরস্কার নেওয়ার সময়েও তাঁর মুখে উঠে এল প্রতিবন্ধীদের জন্য লড়াইয়ের কথা। জানালেন, “ওদের সবার সঙ্গে পুরস্কারটা ভাগ করে নিলাম।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন