মারের মুখে ভাত চাইল চোর

ঠিক যেন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সেই চোর। যে বলেছিল, “খাইতে পাইলে কে চোর হয়?” শনিবার দুপুরে বালিতে সোনার হার ছিনতাই করে ধরা পড়া চোরও মারমুখী জনতাকে কাতর আর্তি জানিয়ে বলল, ‘‘মারার আগে একটু ভাত খেতে দেবেন। বড্ড খিদে পেয়েছে।’’ চোরের এমন আর্তি শুনে ভোল বদলে গেল মারমুখীদের। যার গণধোলাইয়ের প্রস্ততি চলছিল, হুড়োহুড়ি পড়ে গেল তাকেই পঞ্চ ব্যঞ্জনে আপ্যায়ন করার।

Advertisement

শান্তনু ঘোষ

বালি শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০১৫ ০১:১৪
Share:

ভাতের পাতে নরেন। শনিবার, বালিতে। —নিজস্ব চিত্র।

ঠিক যেন ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর সেই চোর। যে বলেছিল, “খাইতে পাইলে কে চোর হয়?”

Advertisement

শনিবার দুপুরে বালিতে সোনার হার ছিনতাই করে ধরা পড়া চোরও মারমুখী জনতাকে কাতর আর্তি জানিয়ে বলল, ‘‘মারার আগে একটু ভাত খেতে দেবেন। বড্ড খিদে পেয়েছে।’’ চোরের এমন আর্তি শুনে ভোল বদলে গেল মারমুখীদের। যার গণধোলাইয়ের প্রস্ততি চলছিল, হুড়োহুড়ি পড়ে গেল তাকেই পঞ্চ ব্যঞ্জনে আপ্যায়ন করার।

স্থানীয় সূত্রে খবর, এ দিন সকালে বালির সাঁপুইপাড়ায় এক বৃদ্ধার গলার হার ছিনতাই করে পালানোর সময়ে ধরা পড়ে যায় নরেন নামে ওই যুবক। ধরা পড়ার আগে সে জল দিয়ে গিলে ফেলেছিল হারটিও। প্রথম দফায় কলা খাইয়ে হার বার করার চেষ্টায় কাজ হয়নি। এক্স-রে করে দেখা যায়, হারটি পাঁজরের খাঁজে আটকে।

Advertisement

আপাত গোবেচারা যুবককে ঘিরে ধরে এর পরে রে-রে মূর্তিতে কয়েক ঘা কষানোর বন্দোবস্ত করে ফেলেছিল এলাকার লোকজন। কিন্তু চোরের মুখে ওই কথা শুনে বদলে গেল মারমুখীদের মন। সাঁপুইপাড়ার ষষ্ঠীতলার একটি পরিচিত পাইস হোটেলে ভাত, ডাল, তরকারি, কাতলা মাছ, পাঁপড় ভাজা দিয়ে মধ্যাহ্ন ভোজ সারে নরেন। খাওয়া শেষে লম্বা ঢেকুর তুলে চোর বাবাজি বলল, “এ বার এক জগ জল খাই। যদি বমি করে হারটা বেরিয়ে যায়।” বলা মাত্রই এল জল। চোর বাবাজিও ঢকঢক করে তা খেয়ে ফেলল। কিন্তু ফের ঢেঁকুড় উঠলেও হার বেরোল না। শেষমেশ জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠল, “এ বার কী করা যায়? মারধর দিয়ে লাভ নেই! তার থেকে পুলিশের কাছে নিয়ে যাই।”

চোর বাবাজিও অবশ্য মনে মনে তখন ইষ্টনাম জপছে। হাত জোড় করে সে বলল, “অনেকটা ভাত খেয়ে নিয়েছি। আর মারবেন না। পেট থেকে হার বার করে দেবই।” এর পরে থানায় নেওয়া হলে পুলিশ নরেন মণ্ডল নামে ওই ছিনতাইবাজকে গ্রেফতার করে।

স্থানীয় সূত্রের খবর, এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ এলাকারই বাসিন্দা আলোরানি দত্ত (৬৮) বাড়িতে পুজো উপলক্ষে প্রতিবেশীকে নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে বৃদ্ধা ধীর গতিতে এলাকার একটি গলি দিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। তখন সাইকেল নিয়ে তাঁর পিছু নেয় নরেন। সুযোগ বুঝেই বৃদ্ধার গলা থেকে প্রায় তিন ভরির সোনার হারটি ছিনিয়ে চম্পট দেয় সে। কিন্তু আলোদেবী চেঁচামেচি জুড়ে দিতেই এলাকার লোকজন ‘চোর-চোর’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। তখন ওই এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন ওই বৃদ্ধার ছেলে অনিল দত্ত। প্রতিবেশীদের সঙ্গে তিনিও তাড়া করেন নরেনকে।

ধরা পড়লে কপালে জুটবে বেধড়ক মার। এই ভেবে প্রাণপণে দৌড়তে শুরু করে নরেন। কিন্তু আঁকাবাঁকা অচেনা গলি পথে বেশি দূর পালানো সম্ভব নয়। তাই ঝুঁকি না নিয়েই রাস্তার পাশের একটি বাড়ির শৌচাগারে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি তুলে দেয় সে। বাইরে তখন হইহই জুড়ে দিয়েছে মারমুখী জনতা। সবাই বলছে ‘‘তুই বেরো এক বার। তার পরে মজা দেখাচ্ছি।’’ কিছুক্ষণ পরে বাইরে এল ওই যুবক। জলে ভিজে রয়েছে জমা। কাচুমাচু হয়ে বলল, “আমিও তো তাড়া করছিলাম। কিন্তু ভয়ে এখানে ঢুকে পড়েছি।” কিন্তু জনতাও ছাড়ার পাত্র নয়। চেপে ধরতেই নরেন স্বীকার করে, শৌচাগারের জল দিয়েই গোটা হারটি গিলে ফেলেছে সে।

এর পরেই তাকে খাওয়ানো হল এক ডজন কাঁঠালি কলা। কিন্তু হার বেরোল না। তখনই আলোদেবীর দুই ছেলে অনিল ও সুনীলবাবু সিদ্ধান্ত নিলেন এক্স-রে করে দেখা দরকার কোথায় রয়েছে হার! এলাকারই একটি এক্স-রে সেন্টারে নিয়ে গিয়ে ওই যুবকের বুক ও পেটের ছবি তুলে দেখা গেল, হারটি দলা পাকিয়ে তার ডান দিকের পাঁজরে আটকে রয়েছে।

কিন্তু পাঁজরে আটকে থাকলে ছেলেটা যদি মরে যায়? এই ভেবেই তাকে নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে। তিনি পরীক্ষা করে জানালেন, বুক থেকে পেটে না নামলে হার বেরোবে না। কী আর করা যায়, ফের নরেনকে নিয়ে আসা হল এলাকায়। মারের বদলে তাকে এ বার দেওয়া হল ভাত। তার পরে তুলে দেওয়া হয় নিশ্চিন্দা থানার পুলিশের হাতে। থানা থেকে নরেনকে ডাক্তার দেখানো হয়। হার বার করার জন্য তাকে হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। তাই আপাতত পুলিশ পাহারায় হাসপাতালে ভর্তি নরেন।

এলাকার বাসিন্দা বাবু মণ্ডল বলেন, “চোর বা ছিনতাইবাজ ধরে গণপিটুনি দেওয়াটা একটা রেওয়াজ। কিন্তু ও এমন ভাবে ভাত খেতে চাইল যে সকলকে মারতে বারণ করলাম।” ছেলেদের মুখে সব শুনে আলোদেবী বললেন, “চোরের ভাত হজম হলেও সোনার হার কি আর হজম হবে!”

এ দিকে, থানায় যাওয়ার পথে কান ধরে নরেন বলল, “আর কোনও দিন এমন করব না। আসলে খাওয়ার টাকা নেই। কেউ কাজও দিচ্ছে না। তাই ভুল কাজটাই করে ফেলেছিলাম। হার ঠিক বার করে দেব। পরে আমাকে ২০০ টাকা দেবেন তো?”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন