সংরক্ষণের দৌলতে ত্রিস্তর পঞ্চায়েতে অর্ধেক আসনে রয়েছেন মহিলা সদস্যরাই। পদাধিকারীদের সংখ্যা সেই অনুপাতে সংরক্ষিত। কিন্তু পঞ্চায়েতের যে সব জায়গায় মহিলাদের স্বতস্ফুর্ত অংশ গ্রহণের প্রশ্ন আসে সেখানে কিন্তু ফল বেশ শোচনীয়। হাওড়া জেলায় মে মাসে গ্রাম সংসদের বৈঠকগুলিতে দেখা গিয়েছে, মহিলাদের অংশগ্রহণ অনেকটা কম। অর্ধেক তো নয়-ই, উল্টে কোনও কোনও ব্লকে মহিলাদের উপস্থিতি এক তৃতীয়াংশের কম।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে গ্রাম সংসদের বৈঠক ডাকা বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়ায়। নিয়ম হল, একটি গ্রাম সংসদে যত জন গ্রামবাসী থাকেন তাঁরা সকলেই গ্রাম সংসদের সদস্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে এখনও কোরামের অভাবে অনেক গ্রাম সংসদে বৈঠক হয় না। পরে ফের বৈঠক ডাকতে হয়। অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত স্থগিত হয়ে যাওয়া বৈঠক পরবর্তী কালে আর ডাকে না। যে সব সংসদে বৈঠক হয় সেখানেই মহিলাদের হাজিরা নগণ্য।
জেলার একেবারে শহর ঘেঁষা ব্লক হল বালি-জগাছা। এখানে ৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতে গ্রাম সংসদের সংখ্যা ১৪১টি। প্রতি সংসদে বৈঠক হয়েছে বলে এই ব্লক সূত্রে জানানো হয়েছে। সংসদের বৈঠকগুলিতে গড় হাজিরা ১৩২ জন গ্রামবাসীর। মহিলাদের হাজিরার গড় হল বৈঠক প্রতি ৪৫ জন। জগৎবল্লভপুরে ১৪টি পঞ্চায়েতে গ্রাম সংসদের সংখ্যা ১৯৯। প্রতিটিতে বৈঠক হয়েছে। এখানে গ্রাম সংসদের বৈঠকগুলিতে গড় হাজিরার হাল বেশ ভাল। ৪১৩ জন করে। কিন্তু মহিলাদের হাজিরা শোচনীয় ভাবে কম। মাত্র ৩০ জন করে মহিলা গড়ে প্রতিটি গ্রাম সংসদের বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। জেলার ১৪টি ব্লকের বাকিগুলিতেও এই চিত্রের ব্যতিক্রম দেখা যায়নি। সাঁকরাইলে ১৬টি গ্রাম পঞ্চায়েতের ২৬৩টি গ্রাম সংসদেই বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে গড় হাজিরা ৪০ জন করে গ্রামবাসীর। মহিলার সংখ্যা মাত্র ৫ জন করে। পাঁচলায় ১৮৫টি গ্রাম সংসদের প্রতিটির বৈঠকে গড়ে ১১৫ জন করে গ্রামবাসী যোগ দিয়েছেন, সেখানে মহিলাদের সংখ্যা ৩১ জন, উলুবেড়িয়া ১ ব্লকে ১০৫ জন করে গ্রামবাসী সংসদগুলির বৈঠকে যোগ দিয়েছেন, মহিলাদের সংখ্যা সেখানে মাত্র ২৫ জন করে। একইরকম উদাহরণ পাওয়া যাবে জেলার বাকি ব্লকগুলিতে। জেলার সামগ্রিক চিত্রটি হল এইরকম, মোট ১৫৭টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে গ্রাম সংসদের সংখ্যা ২৪৩১টি। বৈঠক হয়েছে ১২৬৪টি সংসদে। গ্রামবাসীদের গড় হাজিরা হল গ্রাম সংসদপ্রতি ৯৫ জন করে। মহিলাদের হাজিরা মাত্র ৩৩ জন করে।
কী বলছেন মহিলা পদাধিকারীরা? এই বিষয়ে আলাদা ভাবে কোনও সচেতনতার প্রমাণ তাঁদের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া গেল না। জেলা সভাধিপতি করবী ধুল জানালেন, তিনি ভেবেই দেখেননি মহিলাদের হাজিরা বাড়ানোর জন্য আলাদা করে কিছু করা দরকার। তাঁর কথায়, “গ্রাম সংসদের বৈঠকে গ্রামবাসীরা যাতে বেশি করে হাজির হন সে বিষয়ে প্রচার চালানো হয়। তবে মহিলাদের বিষয়ে আলাদা করে প্রচার হয় না।” আর সাঁকরাইল পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি নবনীতা নস্করের মত, কেউ আসতে না চাইলে জোর করে তাঁকে ধরে আনা যায় না। তিনি বললেন, “আমরা তো গ্রাম সংসদের বৈঠকে হাজির হওয়ার জন্য সবাইকেই বলি। মাইকের মাধ্যমেও প্রচার করি। কিন্তু মহিলারা না আসলে কী করব?” পাশাপাশি পাঁচলা ব্লকের বনহরিশপুর পঞ্চায়েতের প্রধান মণিরা বেগমকে ফোন করা হলে ধরলেন তাঁর স্বামী। তিনি বললেন, “যা বলার আমাকে বলুন।” একই অভিজ্ঞতা হল, এই ব্লকেরই জলা বিশ্বনাথপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সাবিনা বেগম মোল্লাকে ফোন করার পরে। প্রধানের স্বামী বলে দিলেন, “এখন প্রধানকে ফোন দেওয়া যাবে না। তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত আছেন।”
গ্রাম সংসদের বৈঠকের নিয়মিত আয়োজন করা, মহিলাদের অংশগ্রহণ বাড়ছে কিনা সে বিষয়ে জোর দেওয়া এইসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন দফতর নিয়মিত খোঁজ-খবর করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কৃতিত্বের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে পুরস্কারের ব্যবস্থাও রয়েছে বলে রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সূত্রের খবর। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের সেই সব উদ্যোগও যে গ্রামের মহিলাদের স্বতস্ফুর্তভাবে পঞ্চায়েতের কাজকর্মে অংশগ্রহণ করাতে পারেনি হাওড়া জেলার চিত্রই তার প্রমাণ।
পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের এক পদস্থ আধিকারিক বলেন, “শুধু সংরক্ষণ নয় মহিলাদের এগিয়ে আনার জন্য সমাজের ভিতরের অংশের তাগিদ দরকার।” ওই আধিকারিকের প্রশ্ন, “পঞ্চায়েতের প্রধানকে ফোন করলে যদি তাঁর স্বামীরা তা ধরেন তা-হলে সংরক্ষণের আসল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ।” তবে একইসঙ্গে তিনি জানান, প্রতিটি জেলা থেকে গ্রাম সংসদের বৈঠকে মহিলাদের হাজিরার হার জানতে চাওয়া হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচারও চালনো হবে।