লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি শিশুর পাশ থেকে কেড়ে নিল মাকে

ডাক্তার দেখিয়ে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল একরত্তি নাজিয়া পরভিন। আচমকা ছুটে আসা গুলি লাগল মায়ের বুকে। রক্তাক্ত মাকে টলে পড়তে দেখে কান্না জুড়ে দেয় মেয়ে। রাস্তায় বসে মাকে জড়িয়ে ধরে ডাকাডাকিও করে। কিন্তু আর সাড়া দেননি নাসরিনা খাতুন (৩৫)। জনতা মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারদের কিছু করার ছিল না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

জগদ্দল শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০২:৪০
Share:

এখানেই গুলি লাগে মায়ের, দেখাচ্ছে নাজিয়া। ইনসেটে নাসরিনা খাতুন। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়।

ডাক্তার দেখিয়ে মায়ের হাত ধরে হেঁটে বাড়ি ফিরছিল একরত্তি নাজিয়া পরভিন। আচমকা ছুটে আসা গুলি লাগল মায়ের বুকে। রক্তাক্ত মাকে টলে পড়তে দেখে কান্না জুড়ে দেয় মেয়ে। রাস্তায় বসে মাকে জড়িয়ে ধরে ডাকাডাকিও করে। কিন্তু আর সাড়া দেননি নাসরিনা খাতুন (৩৫)। জনতা মহিলাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ডাক্তারদের কিছু করার ছিল না।

Advertisement

প্রকাশ্য রাস্তায় দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্যে এর আগে নিরীহ মানুষের প্রাণ গিয়েছে নদিয়ার শান্তিপুর, কৃষ্ণগঞ্জে। শনিবার সকালে সেই তালিকায় যুক্ত হল উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলও। নাসরিনার বাড়ি জগদ্দলের মেঘনা মোড়ে। ছ’বছরের মেয়ে নাজিয়া এবং নিজের চিকিৎসার জন্য এ দিন বেলা ১০টা নাগাদ ভাটপাড়া পুর-হাসপাতালে গিয়েছিলেন ওই বধূ। সেখান থেকে বেরিয়ে বেলা ১২টা নাগাদ ভাটপাড়া পুরসভার সামনে ঘোষপাড়া রোড পেরিয়ে এক নম্বর গলিতে মেয়েকে নিয়ে সবে ঢুকছিলেন তিনি। তখনই গুলিবিদ্ধ হন।

ভাটপাড়ার তৃণমূল বিধায়ক তথা পুরপ্রধান অর্জুন সিংহের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত প্রোমোটার কালামউদ্দিন আনসারি পুলিশকে জানিয়েছেন, তোলা না দেওয়ায় শাহবাজ, পি কে, নিজাম-সহ এলাকার পাঁচ দুষ্কৃতী তাঁকেই খুন করতে এসেছিল। ঘটনার সময়ে তিনি নাসরিনার খুব কাছাকাছি হাঁটছিলেন। কালামউদ্দিনের কথায়, “গুলির আওয়াজ শুনে মাথা নিচু করেছিলাম। তার পরেই দ্বিতীয় গুলি চালায় সমাজবিরোধীরা। সেটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে মহিলার প্রাণ নেয়।” এর পরেই বেলা দেড়টা নাগাদ এলাকার পরিচিত দুষ্কৃতী শাহবাজের বাড়িতে ভাঙচুর করে জনতা। তবে সে সময় বাড়িতে কেউ ছিল না।

Advertisement

ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের গোয়েন্দাপ্রধান অজয় ঠাকুর জানিয়েছেন, দুষ্কৃতীরা কেন ওই প্রোমোটারকে লক্ষ করে খোলা রাস্তায় গুলি চালাল, তা দেখা হচ্ছে। রাতে ভাটপাড়া থেকে শাহবাজকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।

বিধায়ক অর্জুন সিংহ বলেন, “ঘটনাটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। পুলিশি ব্যবস্থা আরও জোরদার করা দরকার। পুলিশকে অবিলম্বে দুষ্কৃতীদের গ্রেফতার করার কথা বলা হয়েছে।” তবে এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, জগদ্দলে সমাজবিরোধীদের বাড়বাড়ন্তের পিছনে শাসক দলের ‘মদত’ রয়েছে। বিধায়ক অবশ্য অভিযোগ মানেননি।

নাসরিনার স্বামী নিজামুদ্দিন চটকল কর্মী। ছোট মেয়ে চার বছরের নাজকে নিয়ে ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, “বোনদের সঙ্গে দেখা করে বিকেলে বাড়ি ফিরবে বলেছিল স্ত্রী। কী করে, কী হল বুঝতে পারছি না!”

প্রকাশ্য রাস্তায় এ ভাবে দুষ্কৃতীর গুলিতে নিরীহ মহিলার প্রাণহানিতে এলাকার লোকজন পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। পুলিশের বিরুদ্ধে একই রকম ক্ষোভ শোনা গিয়েছিল শান্তিপুর এবং কৃষ্ণগঞ্জেও। গত বছর জুলাইতে দু’দল দুষ্কৃতীর লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শান্তিপুরের মোসে বেওয়া নামে এক নিরীহ প্রৌঢ়া। তার পরের মাসে কৃষ্ণগঞ্জে দু’দল দুষ্কৃতীর লড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গুলিতে প্রাণ যায় কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা, ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র ইন্দ্রনীল রায়ের।

জগদ্দলের বাসিন্দাদের অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশি-নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়েই এলাকায় দুষ্কৃতী-রাজ বেড়ে চলেছে। গত তিন মাসে ১০টিরও বেশি খুন হয়েছে এলাকায়। চুরি-ছিনতাই লেগেই রয়েছে। অথচ, জগদ্দল থানায় পাঁচ মাস ধরে কোনও ইনস্পেক্টর-ইন-চার্জ নেই। এ দিনের ঘটনার জেরে রাতে ভাটপাড়া তদন্ত কেন্দ্রের ওসি বদল করা হয়।

কী হলে, কী হবে সে সব জানে না নাজিয়া। পুলিশ এলে সে-ই দেখিয়ে দিয়েছে কোথায় পড়ে গিয়েছিলেন মা। একরত্তি মেয়েটি টানা বলে চলেছে, “মা পড়ে গেল। কত ঠেললাম, আর উঠল না!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন