হুমায়ুন কবীর। —ফাইল চিত্র।
অবশেষে তৃণমূল থেকে নিলম্বিত হলেন ভরতপুরের বিধায়ক হুমায়ুন কবীর। বৃহস্পতিবার কলকাতায় তৃণমূল ভবনে আয়োজিত এক সাংবাদিক বৈঠকে মুর্শিদাবাদ জেলার এই বিতর্কিত নেতাকে দল থেকে নিলম্বিত করার কথা ঘোষণা করেন কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। এই সাংবাদিক বৈঠকে ফিরহাদের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন মুর্শিদাবাদ জেলার দুই নেতা, রাজ্যের বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী আখরুজ্জামান ও হরিহরপাড়ার বিধায়ক নিয়ামত শেখ। মুর্শিদাবাদ জেলার এই দুই নেতা দলের সিদ্ধান্তকে ‘যথার্থ’ বলে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে সাসপেনশন সংক্রান্ত কোনও চিঠি তিনি পাননি বলেই দাবি করেছেন হুমায়ুন। বৃহস্পতিবারের সাংবাদিক বৈঠকে ফিরহাদ জানিয়ে দিয়েছেন, দল আর তাঁর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। তবে সাসপেনশনের কথা জানার পর হুমায়ুন দাবি করেছেন, আগামী ২২ ডিসেম্বর তিনি নতুন দল তৈরির ঘোষণা করবেন।
বেলডাঙায় ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ তৈরির ঘোষণা করেছিলেন হুমায়ুন। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিন ওই মসজিদ প্রতিষ্ঠার দিন হিসাবে বেছে নেওয়ায় বিস্তর আপত্তি রয়েছে তৃণমূল নেতৃত্বের। যে কারণে প্রথম থেকেই হুমায়ুনের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন তৃণমূল নেতৃত্ব। কিন্তু নিজের অবস্থানে অনড় হুমায়ুন। দলকে বুঝিয়েছিলেন, কোন অবস্থাতেই তিনি বাবরি মসজিদ নির্মাণ থেকে সরবেন না। নিজের সেই অনড় অবস্থানের কারণেই তাঁকে শেষ পর্যন্ত তৃণমূল থেকে ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল। তবে এমন ঘোষণা প্রসঙ্গে হুমায়ুন বলছেন, ‘‘আমি এখনও কোনও চিঠি পাইনি। সঠিক না জেনে কোনও মন্তব্য করব না। অপেক্ষা করুন, অনেক কিছু বলার আছে।’’ সঙ্গে জুড়ে দেন, ‘‘আগামিকাল শুক্রবার কিংবা সোমবার বিধায়কপদ থেকে ইস্তফা দেব। আমাকে চক্রান্ত করে সাসপেন্ড করা হয়েছে। ৬ তারিখের কর্মসূচি অপরিবর্তিত থাকছে।’’
কলকাতার সাংবাদিক বৈঠকে ফিরহাদ বলেন, ‘‘কেউ কোনও মসজিদ তৈরি করতেই পারেন। তবে সেই ঘটনায় যেন কোনও সাম্প্রদায়িক উস্কানি না থাকে। আমিও চেতলা এলাকার একটি মসজিদের মুতওয়াল্লি। সেই বিষয় নিয়ে কারও কোনও আপত্তি নেই, নেই কোনও সাম্প্রদায়িক উস্কানি। কিন্তু একটি মসজিদ নির্মাণের কথা বলে যে ভাবে ধর্মীয় ভাবাবেগকে উস্কানি দেওয়া হচ্ছে, তা আমাদের মতো রাজনৈতিক দলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।’’ ফিরহাদের দাবি, হুমায়ূনের এমন কর্মকাণ্ড রাজ্যের সম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে নষ্ট করতে পারে। দায়িত্বশীল রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে হুমায়ূনের এমন অবস্থান দলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাই তাঁকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। মুখ্যমন্ত্রীর সভায় ডাক পেয়ে বৈঠকে যোগ দিতে এসেছিলেন ভরতপুরের বিধায়ক, যাঁকে গ্রেফতারের নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস। ঘটনাচক্রে, নাটকীয় ভাবে তখনই কলকাতায় সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁকে নিলম্বিত করার কথা জানান ফিরহাদ। হুমায়ুনও বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলে থাকাকালীন তাঁর সাসপেনশনের কথা জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে সভাস্থল থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।
সাসপেন্ড হওয়ার খবর পেয়ে বহরমপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাস্থল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন হুমায়ুন। বৃহস্পতিবার। — নিজস্ব চিত্র
সভাস্থল থেকে বেরিয়ে আনন্দবাজার ডট কম-কে তিনি বলেন, ‘‘২২ ডিসেম্বর নতুন দল ঘোষণা করছি। ১৩৫ আসনে প্রার্থী দেব। তৃণমূল ও বিজেপিকে বুঝিয়ে দেব হুমায়ুন কবীরের কত দম।’’ অন্য দিকে, মুর্শিদাবাদ সংগঠনিক জেলা তৃণমূলের সভাপতি অপূর্ব সরকার বলেছেন, ‘‘গোটা বিষয়টির উপরে রাজ্য নেতৃত্বের নজর ছিল। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সেখান থেকে নেওয়া হয়েছে।’’ তবে হুমায়ুনের তৃণমূল থেকে সাসপেনশনের ঘটনা নতুন বিষয় নয়। এর আগে ২০১৫ সালেও তাঁকে দল থেকে ছ’বছরের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। সেই সময়ের মাঝে তিনি নির্দল প্রার্থী হিসাবে ২০১৬ সালে রেজিনগরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন। তার পর তিনি ফিরে যান কংগ্রেসে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিতে যোগদান করে মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীও হয়েছিলেন হুমায়ূন। তবে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আবার তৃণমূলে ফিরে রেজিনগরের বদলে ভরতপুরে প্রার্থী হন। সেই ভরতপুর আসন থেকে জিতে বর্তমানে তিনি বিধায়ক।
২০২১ সালে তৃণমূলের বিধায়ক হয়ে একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য করে দলের রোষানলে পড়েছেন হুমায়ুন। বার বার তাকে শো কজ় করা হলে, ক্ষমাপ্রার্থনা করে আবার স্বমহিমায় নানা বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করে বহাল তবিয়তে থেকেছেন তিনি। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল নেতৃত্ব আর কোনও ঝুঁকি নিতে রাজি নন। দলের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বেলডাঙায় ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা মেনে নিতে পারেননি তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব। তাই তাঁকে দল থেকে পুরোপুরি ছেঁটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। হুমায়ুনের এমন রাজনীতি আখেরে বিজেপির হাত শক্ত করবে বলে উষ্মাপ্রকাশ করেন ফিরহাদ।