ইস্কনে নমাজ-সংকীর্তনে সম্প্রীতির সুর

ঘন সবুজ গালিচা মোড়া চোখ জুড়ানো ঘর। চারিদিকে সাজানো শতাধিক টেবিল-চেয়ার। প্রতিটি চেয়ারের গায়ে অতিথিদের নাম লেখা। তারানুম সুলতানা, সাইনুর হক, কাসেম মাস্টার, সাজ্জেত মাস্টার, আমিন আলি, আয়েব নবী, আনসার শেখ। দ্রুত গতিতে টেবিলে সাজানো হচ্ছে রকমারি খাদ্য।

Advertisement

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৬ ০৬:৩১
Share:

মায়াপুরের ইস্কনে ইফতার। — সুদীপ ভট্টাচার্য

ঘন সবুজ গালিচা মোড়া চোখ জুড়ানো ঘর। চারিদিকে সাজানো শতাধিক টেবিল-চেয়ার। প্রতিটি চেয়ারের গায়ে অতিথিদের নাম লেখা। তারানুম সুলতানা, সাইনুর হক, কাসেম মাস্টার, সাজ্জেত মাস্টার, আমিন আলি, আয়েব নবী, আনসার শেখ। দ্রুত গতিতে টেবিলে সাজানো হচ্ছে রকমারি খাদ্য।

Advertisement

জনা দশেক বৈষ্ণবভক্ত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেবিল সাজাতে গিয়ে গলদঘর্ম। উদ্বিগ্ন মুখে ঘন ঘন ঘড়ি দেখেছেন মুল উদ্যোক্তা জগদার্তিহা দাস এবং অলয়গোবিন্দ দাস। কাঁটায় কাঁটায় সন্ধ্যা ৬.২৯ মিনিটে ইফতার শুরু করতেই হবে। তার আগে আয়োজন সম্পূর্ণ হওয়া চাই।

আয়োজনও এলাহি। পানীয় তিন রকমের। রুহু আফজা, অরেঞ্জ জুস এবং ঠান্ডা পানীয়। স্ন্যাক্সে রয়েছে ভেজিটেবল চপ, আলুর চপ, ছোলা সেদ্ধ, চানাচুর, মুড়ি। শুকনো ফলের মধ্যে কাজু, কিসমিস, সরাসরি দুবাই থেকে আনানো খেজুর, ডুমুর এবং পেস্তা। মূল মেনুতে ভেজ বিরিয়ানি, সয়াবিন কষা আর স্মল স্প্রিং রোল। মিষ্টির তালিকায় সন্দেশ, পান্তুয়া, জিলিপি, পায়েস, পেস্ট্রি। শেষ পাতে পাঁচরকম ফল, আম, তরমুজ, আপেল, কলা, শশা। মুখশুদ্ধি হিসাবে আমলকী।

Advertisement

এই ভাবেই বুধবার সন্ধ্যায় মায়াপুর ইস্কনের চন্দ্রোদয় মন্দিরের তরফে ইফতারে আপ্যায়িত করা হল স্থানীয় সংখ্যালঘুদের। এ সি ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রতিষ্ঠিত ইস্কনের পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে এই প্রথম ইফতার সমাবেশের আয়োজন করল ইস্কন কর্তৃপক্ষ।

এ দিন ছিল রমজান মাসের ষোলতম দিন। ইস্কনের গীতাভবনে আয়োজন করা হয়েছিল এই ইফতারের। যোগ দিয়ে ছিলেন বিভিন্ন স্তরের স্থানীয় সংখ্যালঘু ধর্মাবলম্বী মানুষ।

এই প্রসঙ্গে ইস্কনের অলয়গোবিন্দ দাস জানান, ইস্কনের পঞ্চাশ বছরকে স্মরণীয় করতে এর থেকে ভালো উৎসব আর কিছুই হতে পারে না বলেই আমাদের মনে হয়েছে। চৈতন্যদেবকে স্মরণ করেই মায়াপুর, বামুনপুকুর সহ সংলগ্ন এলাকার সমস্ত মসজিদ, ইদ্গা, মাদ্রাসার প্রধানসহ এলাকার বিশিষ্টদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাঁরা সকলেই এসেছেন।

শুধু আসাই নয়, গীতাভবনে রাজকীয় ইফতার সেরে নিয়ম মাফিক মগরিবের নমাজও পড়লেন তাঁরা। নমাজ পরিচালনা করলেন হাফিজ ক্বারী সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, “আমাদের দেশে এমনটাই তো স্বাভাবিক।”

ইফতারে আসা স্থানীয় মানুষদের আপ্যায়নের ফাঁকে জগদার্তিহা দাস বলেন, “সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির যে বার্তা চৈতন্য মহাপ্রভু আজ থেকে সাড়ে পাঁচশো বছর আগে দিয়ে গিয়েছিলেন এই আয়োজন তাঁর সেই পথের অনুসরণ মাত্র। সুদীর্ঘ কাল এখানে হিন্দু মুসলমান দুই ধর্মের মানুষ পাশাপাশি ভাইয়ের মতো বাস করেছে। একজনের উৎসবে অন্যজন সামিল হবেন এটাই স্বাভাবিক।”

তাঁর কথার খেই ধরে মায়াপুরের বাসিন্দা হাজী আবু তাহের মণ্ডল বলেন “বহুকাল ধরে ইস্কনের হবিবপুরের রথ আমারই তত্ত্বাবধানে তৈরি হয়। তবুও পুরো ব্যাপারটাই খুব ভাল লাগছে। আজকের সন্ধ্যার অনুভূতি একদম অন্যরকম।”

সোয়া ছটা নাগাদ সব চেয়ার ভর্তি। আয়োজনও সম্পূর্ণ ততক্ষণে। ইস্কনের তরফে সকলের হাতে হলদে গোলাপ তুলে দিলেন জগদার্তিহা দাস, অলয়গোবিন্দ দাস এবং অনান্যরা। ছ’টা কুড়ি নাগাদ হাতে মাইক তুলে নিলেন হাফিজ ক্বারী সাইফুল ইসলাম। সংক্ষেপে সকলের জন্য আল্লার দোয়া চাইলেন। তিনি বললেন এই ইফতার সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির ইতিহাসে স্থান পেয়ে গেল। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা ৬.২৯ মিনিটে পৌছতেই রমজান মাসের ষোলতম দিনের উপবাস ভঙ্গ করলেন শতাধিক রোজাদার।

এ দিনের ইফতারে সবচেয়ে প্রবীণ মানুষটি ছিলেন কাশেম আলি চৌধুরী। বয়স আশি পেরিয়ে গিয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত এই স্কুলশিক্ষক যে কবে থেকে রোজা করেছেন তা নিজেই মনে করতে পারেন না।

কেমন লাগছে?

উত্তরে রসিক মানুষটি বললেন, “খুব ভালর থেকেও যদি বেশি কিছু থাকে তেমন।”

কথার ফাঁকেই সময় হয়ে গেল মাগরিবের নমাজের। ইফতারের কিছু পরেই সময় মাগরিবের নমাজের।

ঘড়ির কাঁটা তখন পৌনে সাতটার ঘরে। সবুজ গালিচার উপর নমাজ পড়তে শুরু করলেন উপস্থিত শতাধিক মানুষ। গীতাভবনের অতবড় হল ঘরে তখন পিন পতনের নৈঃশব্দ। কিছুটা দূরে ইস্কনের মুল মন্দিরে ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে সন্ধ্যারতি।

গঙ্গার পূর্ব পাড়ে ঘনিয়ে আসা আষাঢ় সন্ধ্যা নমাজ আর সংকীর্তনে তখন ঘন হয়ে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন