দশ লাখ ফেললেই কিডনি! দালাল জানেন গোপন কম্মোটি

কিন্তু ‘আনরিলেটেড’ কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়পত্র পায় কী ভাবে? নিয়মমাফিক স্বাস্থ্য ভবনে মাসে দুটি করে বৈঠক হয়। সেখানে কিডনি দানের আবেদনপত্র জমা পড়ে। তা খতিয়ে দেখে দাতা-গ্রহীতার সঙ্গে কথা বলেন আধিকারিকেরা।

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:২৪
Share:

প্রতীকী ছবি।

‘‘কী করব, বুঝতে পারছি না।’’

Advertisement

‘‘কে ডোনেট করবে কিডনি? ডাক্তার তো বলছেন খুব তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে হবে। আমার পেশেন্টের তা হলে কী হবে?’’

‘‘টাকা থেকেও তো দেখছি লাভ নেই।’’

Advertisement

মোবাইল ফোনের অন্য প্রান্তে এক কাল্পনিক চরিত্রের সঙ্গে কথা বলছিলাম। হাতে ছিল প্রেসক্রিপশনের ফাইল।

বাইপাসের ধারে, বেসরকারি হাসপাতালের বাইরে চায়ের দোকান। কিডনি ব্যবসার অন্যতম ‘ঠেক’-এর মধ্যে এমন কয়েকটি দোকানও যে রয়েছে, সে খবর আগেই মিলেছিল। সেই অনুযায়ী কিডনি বিকল হয়ে যাওয়া এক রোগীর প্রেসক্রিপশন জোগাড় করে সটান ওই দোকানে। তার পর চা খেতে খেতে মোবাইলে উচ্চস্বরে একটানা বলে যাওয়া!

কথা শেষ হওয়ার পরে চায়ের দাম মেটাচ্ছি, ইশারায় বসতে বললেন দোকানের মালিক। কয়েক মিনিট পরে কাছে এসে বললেন, ‘‘ডোনারের খোঁজ করছেন? আমার চেনা আছে। কথা বলবেন?’’ বললাম, অবশ্যই বলব। মালিক বললেন, ‘‘প্রচুর লোক এখানে আসেন তো! চেনাজানা হয়ে যায়। লোকের কষ্ট সহ্য করতে পারি না। একটু-আধটু হেল্প করার চেষ্টা করি।’’ মোবাইলে কাউকে ফোন করলেন তিনি। আধ ঘণ্টার মধ্যেই হাজির এক জন— ‘এজেন্ট’ বা দালাল! জানতে চাইলেন, ‘‘পেশেন্ট মেল না ফিমেল? ব্লাড গ্রুপ কী?’’ জানার পরেই আশ্বাস, ‘‘সব হয়ে যাবে। ভাববেন না।’’ কী ভাবে হবে? ডোনার নেই তো! তাঁর জবাব, ‘‘ওটা দেখা আমার কাজ। আপনি ১০ লাখ রেডি রাখুন।’’ ১০ লাখ? উত্তর এল, ‘‘এটাই এখন প্যাকেজ রেট।’’

এতই সহজ সব কিছু? কলকাতার ‘কিডনি বাজার’ সদর্পে জানিয়ে দিচ্ছে, এতটাই সহজ! আইন অনুযায়ী, ‘আনরিলেটেড’ অর্থাৎ সম্পর্কহীন ব্যক্তির কাছ থেকে কিডনি নেওয়া যায় না। আর সম্পর্ক থাকলেও সেখানে আর্থিক লেনদেন চলতে পারে না। অথচ এখানে সব চলছে নির্বিচারে। কলকাতায় যে চিকিৎসকেরা এই ‘আনরিলেটেড’ কিডনি লেনদেনে যুক্ত নন, তাঁরা জানাচ্ছেন, বছর কয়েক আগে পর্যন্ত ‘আনরিলেটেড’ কিডনি প্রতিস্থাপনের ‘হাব’ ছিল ‘টু সি’— কলকাতা এবং কোয়মবত্তূর। ধরপাকড় হওয়ায় কোয়মবত্তূরে কার্যকলাপ আপাতত স্তিমিত। ফলে কলকাতা এখন দেশে এ ধরনের কিডনি প্রতিস্থাপনের কার্যত একমাত্র ‘হাব’ বলেই ওই চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা।

কিন্তু ‘আনরিলেটেড’ কিডনি প্রতিস্থাপন ছাড়পত্র পায় কী ভাবে? নিয়মমাফিক স্বাস্থ্য ভবনে মাসে দুটি করে বৈঠক হয়। সেখানে কিডনি দানের আবেদনপত্র জমা পড়ে। তা খতিয়ে দেখে দাতা-গ্রহীতার সঙ্গে কথা বলেন আধিকারিকেরা। আধিকারিকদের সামনে গিয়ে বলতে হয়, ‘আমি আত্মীয়। স্বেচ্ছায় দিচ্ছি। কোনও টাকা-পয়সার লেনদেন নেই।’ পরিচয়পত্র দেখাতে হয়। জমা দিতে হয় বাড়ির ঠিকানা ও তার প্রমাণপত্র। অভিযোগ, সে ক্ষেত্রেও দালালদের খেলা ঠেকানো যায়নি। এক দালালের সাফ কথা, ‘‘আমরা স্বাস্থ্য ভবনের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি। কারণ, আমরা জানি কোথায়, কার সঙ্গে কথা বলে রাখতে হয়। এর পরে অফিসারেরা হোম ভিজিট করেন। সেখানে তাঁদের মন জুগিয়ে চলতে পারলে সব ঠিকঠাক।’’ কী ভাবে মন জোগাতে হয়? দালাল হাসেন, ‘‘এটাও আবার বলে দিতে হবে নাকি?’’

স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য এই অভিযোগ পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন। স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রের কথায়, ‘‘বহু আগে কিছু অনিয়ম ছিল। এখন সরকারি হাসপাতালে কোনও সমস্যা নেই। আর বেসরকারি হাসপাতালে কিডনি চক্র সক্রিয় কি না, সে ব্যাপারে কড়া নজরদারি রয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনের যোগসাজশের প্রশ্নই ওঠে না। সবটাই মিথ্যা অভিযোগ।’’ যদিও স্বাস্থ্য ভবনেরই এক কর্তার কথায়, ‘‘আউট অব লাভ কিডনি দান করা যায়। একটা কেস এসেছিল। এক ড্রাইভার দু’মাস কাজ করার পরই গাড়ির মালিককে ভালবেসে কিডনি দিয়ে দিলেন। বিশ্বাসযোগ্য? অথচ আমাদের ভবন থেকেই তো ছাড়পত্র দিল।’’

সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন একাধিক রোগীর অভিযোগ, ডাক্তার, নার্স, ডায়ালিসিস ইউনিটের কর্মী, টেকনিশিয়ান, ট্রলিবয়দের একাংশও এই চক্রে যুক্ত। রাজ্যের এক সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে মাস কয়েক আগে ভর্তি হওয়া এক কিডনি রোগী জানান, ডোনার জোগাড় করতে খরচ হয়েছে কয়েক লক্ষ টাকা। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ওয়ার্ড বয়, নার্স, টেকনিশিয়ানদের কেউ কেউ ছেঁকে ধরে। যারা আগে দশটা প্রশ্ন করলে একটার জবাব দিত, ডোনার খুঁজছি শুনে তারাই বন্ধু হয়ে ওঠে। সকলেই এমন তা নয়, কিন্তু অনেকেই এর সঙ্গে যুক্ত। ডাক্তারবাবুরা সব জানেন।’’ বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি এক রোগীর মেয়ের কথায়, ‘‘বাবার ডায়ালিসিস চলছিল। আমি বাইরে বসেছিলাম। নার্স এসে বললেন, আর কতদিন ডায়ালিসিস চালাবেন? যদি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে চান বলবেন। আমার হাতে ডোনার আছে। ডাক্তারবাবুকে জানালে তিনি বললেন, যোগাযোগ করে দেখতে পারেন। আবার তাঁকে বললে তিনিও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন!’’

অ্যাসোসিয়েশন অব হসপিটালস অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার সেক্রেটারি রূপক বড়ুয়া অবশ্য বলেন, ‘‘সব বেসরকারি হাসপাতালকেই বলা আছে, যাতে তারা স্বাস্থ্যভবনের নিয়ম মেনে চলে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’’ তিনি যদি জানতেন, বাইপাসের এক হাসপাতালের নার্স কী বলেছেন! ওই নার্সের কথায়, ‘‘সব জেনেও ভয়ে মুখ খুলতে পারি না। এক ডাক্তারবাবু বলেছিলেন, বাড়াবাড়ি করলে ক্ষতিটা তোমারই। আমি তো জানি, মুখ খুললে শুধু চাকরি নয়, বেঘোরে প্রাণটাই যেতে পারে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন