Education

পাম্পের আলোয় মায়ের পাঠশালা

এলাকাবাসী অবশ্য প্রায় রোজই দেখেন দৃশ্যটি। চার লেনের মহাসড়কের পাশে পাম্পের ধারে দরমা-বেড়ার জীর্ণ বাড়ি। সন্ধে নামলেই সে বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।

Advertisement

অনির্বাণ রায়

জলপাইগুড়ি শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২৩ ০৭:৪১
Share:

ছেলেমেয়েকে পড়াচ্ছেন সবিতা তন্ত্র। ছবি: সন্দীপ পাল।

বাচ্চারা পড়া থামায়নি। থামাতে দেননি তাদের মা।

Advertisement

রাস্তার ধারে সন্ধের পেট্রল পাম্প। তার নিয়ন আলোটুকুই ভরসা। সে পাম্পের কংক্রিটের মেঝেয় বসে ছোট্ট ছেলেটি দুলে দুলে পড়ছে, “আমার যেন লাগল ভারী ভাল/চেয়ে দেখি— আকাশখানা এক্কেবারে কালো।/কালো হল বকুলতলা...।”

বইয়ের পাতায় ছাপা লাইন ধরে মায়ের আঙুল চলছে, আর পাশে বসা বালক পড়ে চলেছে। জলপাইগুড়ি শহর লাগোয়া পাহাড়পুরের পেট্রোল পাম্পের পাশে সোমবার সন্ধেয় চাদর বিছিয়ে ছেলেমেয়েকে পড়াতে বসেছিলেন মা। এলাকাবাসী অবশ্য প্রায় রোজই দেখেন দৃশ্যটি। চার লেনের মহাসড়কের পাশে পাম্পের ধারে দরমা-বেড়ার জীর্ণ বাড়ি। সন্ধে নামলেই সে বাড়ি জুড়ে অন্ধকার। বিদ্যুৎ সংযোগ নেই। তাই পেট্রল পাম্পের আলোর নীচে বসেই চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে এবং আরও ছোট দুই মেয়েকে পড়াতে বসান সবিতা তন্ত্র। রাত ১০টার সময় পাম্পের আলো নিভে যায়। পড়াও শেষ করতে হয়। যে দিন পাম্প বন্ধ থাকে, আলো জ্বলে না, সে দিন রান্নাঘরে কুপি জ্বেলে ছেলেমেয়েকে পড়ান অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করা সবিতা।

Advertisement

দরমার বেড়ার একটি শোয়ার ঘর। এক ঘরেই সবার ঠাঁই। সবিতা ও তাঁর স্বামী আপন তন্ত্র, চতুর্থ শ্রেণির পড়ুয়া ছেলে, প্রথম শ্রেণির ছাত্রী দুই যমজ মেয়ে এবং সবিতার শাশুড়ি— সকলেই থাকেন একটি ঘরে। সে ঘরে আলো-পাখা নেই। আপন দিনমজুর। বাড়ির সামনে একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। সেটি তাঁর মা মনু দেখাশোনা করেন। এক সময়ে এই বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ ছিল আপনের বাবা নীরেন তন্ত্রের নামে। ২০১৫ সালে আচমকা বকেয়া বিল আসে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার।

আপনের দাবি, “দু’টো আলো জ্বলত শুধু। বাড়িতে পাখা ছিল না। ফ্রিজ, টিভি তো দূরস্থান। এত টাকার বকেয়া বিল ভুল করে এসেছিল বোধ হয়। বিল না দেওয়ায়, বিদ্যুৎ দফতর পুলিশকে জানাল। এত টাকা কী করে দেবেন, সে চিন্তায় বাবা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মঘাতী হলেন। বিদ্যুৎ দফতর সংযোগ কেটে দিয়েছে। তার পরে, আমরা চেয়েও পাইনি সংযোগ।” বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার জলপাইগুড়ির আঞ্চলিক ম্যানেজার সঞ্জয় মণ্ডল অবশ্য বলেন, “ওই পরিবারের এক লক্ষ ৪৬ হাজার টাকা বিল বাকি আছে। ভুলবশত বিল পাঠানো হয়নি। জরিমানাও করা হয়েছিল। বকেয়া বিল না মেটালে, ওই পরিবারকে ফের সংযোগ দেওয়া সম্ভব নয়।” বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার দাবি, ওই লাইন থেকে বিদ্যুৎ চুরির জরিমানা করা হয়েছিল। যদিও আপন দাবি করেছেন, বিদ্যুৎ চুরি হয়ে থাকলে জানা নেই। বাড়িতে একটা মোবাইল রয়েছে। সেটি পাশের পাম্পে গিয়ে চার্জ করে তন্ত্র পরিবার। পাম্পের কলের জল দিয়েই স্নান সারতে হয়। মেলেনি সরকারি শৌচাগারও।

ছেলেমেয়েদের পড়াতে পড়াতে সবিতা বললেন, “পাম্পে তেল ভরতে অনবরত গাড়ি, বাইক যাতায়াত করে। চাকা থেকে ছিটকে ধুলো-বালি চোখেমুখে লাগে। কিন্তু পাম্প ছা়ড়া, আলো কোথায়! বড় রাস্তায় গিয়ে তো বসা যায় না।”

ছেলে বাড়ির পাশের স্কুলে পড়ে, দুই মেয়ে পড়ে শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে। সবিতা দাবি করেন, “বাড়িতে শিক্ষক রাখার ক্ষমতা নেই। আর শিক্ষক এলেও অন্ধকারে পড়াবেন কী করে! তাই যতটা পারি, পাম্পের আলোর ওদের নিয়ে বসি। পড়াশোনা না করলে, যে ওদের ভবিষ্যতেও আলো আসবে না!”

পাম্পের নিয়ন আলো চকচক করে মায়ের চোখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন