লড়াইটা রেকর্ড ভাঙার, আবার রেকর্ড গড়ারও।
কংগ্রেসের গড় রেলশহরে পদ্ম ফুটবে কি না, তা সময় বলবে। তবে ময়দানে নেমে নব্বই পেরনো জ্ঞানসিংহ সোহন পাল বলছেন, ‘‘লড়াই কোথায়!’’ ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তো এই খড়্গপুরেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। গত বছর পুরভোটেও কংগ্রেসকে হতাশ করেছিল খড়্গপুর। তাহলে এ বার? এরপরেও অবশ্য ভোটের ময়দানে কোনও প্রতিপক্ষ দেখতে পাচ্ছেন না রেলশহরের বিদায়ী বিধায়ক। খড়্গপুরের দশ বারের বিধায়ক চাচা বলছেন, ‘‘এই শহরের মানুষ আমায় চেনে। তাই জয় নিশ্চিত।” রেকর্ড অটুট থাকবে বলে আশাবাদী কংগ্রেস নেতৃত্বও।
রেকর্ড ভাঙতে অবশ্য সকলের আগে মাঠে নেমেছে তৃণমূল। প্রার্থী তালিকা ঘোষণার পর থেকেই এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন তৃণমূল প্রার্থী রমাপ্রসাদ তিওয়ারি। ‘বহিরাগত’ তকমা ঝেড়ে ফেলে সকলের পাশে থাকার বার্তাও দিচ্ছেন। চাচাকে আটকাতে বিজেপির হয়ে ময়দানে নেমেছেন রেলশহরে ‘বহিরাগত’ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষও। শহরে দলের প্রথম কর্মিসভায় তাঁকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘‘লোকসভায় আমরা খড়্গপুরে ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েছিলাম। এ বার আপনারা আমাকে ৫০ শতাংশ ভোট পাইয়ে দিন।’’ লোকসভা ভোটের হিসেব মাথায় রেখেই আশায় বুক বাঁধছে গেরুয়া শিবির।
চাচার বিরুদ্ধে ভোটযুদ্ধে নামলে তাঁর প্রতি সম্মান জানাচ্ছেন যুযুধান দু’পক্ষই। তৃণমূল প্রার্থী রমাপ্রসাদ বলছেন, “চাচাকে শ্রদ্ধা করি।” চাচার প্রসঙ্গে বিজেপি প্রার্থীরও বক্তব্য, ‘‘চাচা এই শহরের প্রতীক। ওঁকে সম্মান করি।”
তবে ভোটের অঙ্ক অবশ্য অন্য কথা বলছে। ২০১১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল-কংগ্রেস জোট প্রার্থী চাচা ৭৫,৪২৫টি ভোট পান। ৫৫.০৬ শতাংশ ভোট ছিল কংগ্রেসের দখলে। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী অনিলকুমার দাস পেয়েছিলেন ৩১.৪৩ শতাংশ ভোট। বিজেপির দখলে ছিল ৬.৭৯ শতাংশ ভোট। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে তৃণমূল ও কংগ্রেস আলাদা লড়াই করে। ওই ভোটে বিজেপির ভোট শতাংশ প্রায় ২৮ শতাংশ বেড়ে হয় ৩৪.৯০। তৃণমূল ও কংগ্রেস পেয়েছিল যথাক্রমে ২৭.১৩ ও ১৪.৫৪ শতাংশ ভোট। বামেদের দখলে ছিল ২০.৪৬ শতাংশ ভোট।
যদিও গত বছর খড়্গপুর পুরসভার নির্বাচনে মুখ থুবড়ে পড়ে বিজেপি। ৩৫ আসন বিশিষ্ট খড়্গপুর পুরসভায় মাত্র ৭টি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় গেরুয়া শিবিরকে। পরে বিজেপির ৫ জন কাউন্সিলর তৃণমূলে যোগ দেন। বর্তমানে খড়্গপুরে বিজেপির কাউন্সিলর সংখ্যা ২। যদিও বিজেপির দাবি, পুরভোটে পুলিশ-মাফিয়া এক হয়ে রেলশহরে ভোট লুঠ করেছে। তাই ওই বার প্রকৃত ভোট চিত্র সামনে আসেনি। এ বার রেলশহর ফের বিজেপির পক্ষেই রায় দেবে।
গত বছর পুরভোটের আগে শহরের একাধিক কংগ্রেস ও বিজেপি কাউন্সিলরের বাড়ির সামনে গুলি, বোমাবাজির অভিযোগ ওঠে। বিরোধীদের অভিযোগ, ভয় দেখিয়ে বিরোধী কাউন্সিলরদের ভাঙিয়ে খড়্গপুরে পুরবোর্ড দখল করেছে তৃণমূল। এ বার মানুষ ভোটে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জবাব দেবেন। বিজেপি প্রার্থী দিলীপবাবুও বলছেন, “বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়ে আমাদের পাঁচ কাউন্সিলরের দল বদল আমাদের সম্মানহানি হয়েছে। তার জবাব দিতেই খড়্গপুরে আমি প্রার্থী হয়েছি। আমরাই শহরে সন্ত্রাস বন্ধ করব।” চাচার মুখেও শোনা যাচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথাই। তৃণমূল প্রার্থী রমাপ্রসাদ তিওয়ারির দাবি, ‘‘রাজ্য সরকার ও খড়্গপুর পুরসভার করা উন্নয়নের মাপকাঠিতেই সাধারণ মানুষ ভোট দেবে। রেলশহর আমাদের পক্ষেই রায় দেবে।’’
রেলশহরে প্রচারে একে অপরকে টেক্কা দিতে অবশ্য চেষ্টার কসুর করেনি রাজনৈতিক দলগুলি। তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খড়্গপুরে পদযাত্রা করেছেন। রেলশহরে সভা করে গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। শহরে বিজেপি প্রার্থীর হয়ে প্রচার করেছেন পি সি সরকার (জুনিয়র), কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু, মনোজ তিওয়ারি। যদিও অন্য প্রার্থীদের তুলনায় অনেক পরে প্রচারে নেমেছেন চাচা। তাঁর প্রচার বলতে গুটিকয়েক রোড-শো আর সভা। কংগ্রেস প্রার্থীর হয়ে খড়্গপুরে প্রচার করেছেন রাজ বব্বর, নাগমা। ব্যস ওইটুকুই। কংগ্রেসের এক নেতা অবশ্য বলছেন, ‘‘আরে অঙ্ক দিয়ে কি আর ভোট হয়! চাচার ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই শেষ কথা।’’
লড়াইয়ে পাল্লা ভারী কার দিকে? প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসে চাচা বলছেন, ‘‘এই শহরে আমার জন্ম। এখানে সবাই আমাকে চেনেন। আমার কি নতুন করে প্রচারের প্রয়োজন আছে?’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘আগে বামেদের সঙ্গে লড়াই করতাম। এ বার বামেদের সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে লড়াই করছি। জয় আসবেই।’’