হাসপাতালে রামনাথবাবু ও সুকেশ্বরী দেবী। ছবি: শুভাশিস ভট্টাচার্য।
পার্ক স্ট্রিটের এক হাসপাতালে পাশাপাশি শয্যায় জায়গা হয়েছে তাঁদের। কখনও এক জন উঠে এসে বসছেন অন্য জনের পাশে। হাতটা আলতো করে ধরছেন। মাথায় হাত বোলাচ্ছেন। অন্য জন হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ছেন, আবার সামলে নিচ্ছেন, আঁকড়ে ধরছেন প্রিয়জনের হাত।
এক জনের বয়স ৭১, অন্য জন ৬৬। স্বামী-স্ত্রী। সাতচল্লিশটা বছর একসঙ্গে পেরিয়েছেন। শেষ জীবনে এসে ক্যানসারও ধরা পড়েছে একসঙ্গে! রামনাথ প্রসাদের বাঁ গালে আর মাড়িতে ক্যানসার চিহ্নিত হয়েছে গত জুন মাসে। স্ত্রী সুকেশ্বরীদেবীর ক্যানসার ধরা পড়েছে তার পাঁচ মাস পরে। সেটাও ওই বাম গালে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, দু’জনেরই গুটখা, খৈনি খাওয়ার দীর্ঘ দিনের অভ্যাস ছিল। তার থেকেই ক্যানসার। দুর্ভাগ্যক্রমে তা দু’জনের একসঙ্গে শুরু হয়েছে।
নিম্নবিত্ত পরিবারের নিঃসন্তান দম্পতি। কে এখন কাকে দেখে, তার ঠিক নেই। ভবিষ্যতেও চিকিৎসার খরচ কী ভাবে চলবে, কে দায়িত্ব নেবেন কেউ জানেন না। ধাপার মাঠের পাশে হাটগাছিয়ায় ঝুপড়িতে সস্ত্রীক থাকতেন কাচের কারখানার অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিক রামনাথ। চেয়েচিন্তে, পাড়া-প্রতিবেশী আর কিছু আত্মীয়ের দয়ায় দিন কাটে। ক্যানসার ধরা পড়ার পরে আত্মীয়-প্রতিবেশীরাই হাসপাতালে ভর্তি করান।
তাঁদের চিকিৎসার খরচ জোগাতে বিভিন্ন সরকারি তহবিলের টাকা চেয়ে আবেদন করেছেন চিকিৎসকেরা। পাশাপাশি ক্যানসার চিকিৎসকদের ভাবাচ্ছে অন্য একটি বিষয়। কলকাতার নামী ক্যানসার বিশেষজ্ঞদের প্রায় প্রত্যেকের কাছেই এ রকম একাধিক কেস এসেছে বা আসছে, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর প্রায় একই সময়ে ক্যানসার ধরা পড়েছে। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা আবার একই ধরনের ক্যানসার।
ক্যানসার ছোঁয়াচে নয়। তা ছাড়া, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে জিনগত সম্পর্কও থাকে না। তা হলে কেন স্বামী-স্ত্রীর প্রায় একই সময়ে, ক্যানসার ধরা পড়ছে? এটা কি নেহাত কাকতালীয়? ক্যানসার চিকিৎসকদের অনেকেরই মত, এর পিছনে খানিকটা পরিবেশ, খাওয়াদাওয়া, নেশার অভ্যাস এবং জীবনযাপনের প্রভাব থাকতে পারে। এই দিকটা এ বার গবেষণা করে দেখা দরকার। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-ই জানাচ্ছে, ২০২৫ সালের মধ্যে দেশের প্রত্যেক পরিবারে এক জন সদস্য ক্যানসারে আক্রান্ত হবেন।
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলছিলেন, চিকিৎসক হিসেবে এমন ১৫-২০টি কেস পেয়েছেন, যেখানে স্বামী-স্ত্রীর প্রায় একইসঙ্গে ক্যানসার ধরা পড়েছে। কখনও দু’জনেরই ত্বকের ক্যানসার, কখনও এক জনের স্তন ক্যানসার। বা এক জনের থাইরয়েডের ক্যানসার, অন্য জনের কোলন ক্যানসার দেখা দিয়েছে।
সুবীরবাবুর কথায়, ‘‘দু’জনেই আর্সেনিকপ্রবণ বা দূষিত ধোঁয়াযুক্ত এলাকায় থাকলে বা প্রচুর সিগারেট-গুটখা খেলে অথবা রাসায়নিক মেশানো শাকসব্জি-মাছ খেলে ক্যানসার হওয়ার আশঙ্কা থাকে।’’ যে হাসপাতালে ওই বৃদ্ধ দম্পতি ভর্তি, সেই নেতাজি সুভাষ ক্যানসার হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায়েরও বক্তব্য, ‘‘একই খাদ্যাভ্যাস বা পরিবেশ থেকে একই পরিবারের একাধিক সদস্যের ক্যানসার হচ্ছে কি না, সেটা খতিয়ে দেখার সময় এসেছে।’’ তাঁর হাসপাতালে গত ১৫ বছরে এমন আট জোড়া দম্পতিকে পাওয়া গিয়েছে, যাঁদের একসঙ্গে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। এঁদের মধ্যে এক দম্পতি জানিয়েছিলেন, তাঁরা প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ‘রেড মিট’ খেতেন। দু’জনেরই কোলন ক্যানসার হয়েছিল। আর এক দম্পতি চেন স্মোকার ছিলেন। দু’জনেরই এক বছরের মধ্যে গলায় ও ফুসফুসে ক্যানসার ধরা পড়ে।’’
ক্যানসার বিশেষজ্ঞ গৌতম মুখোপাধ্যায়ের মতে, পরিবারে স্বামী বা স্ত্রী-র ক্যানসার ধরা পড়লে অন্য জন হঠাৎ বেশি সচেতন হয়ে যান। হয়তো অনেক দিন ধরে তাঁর নিজেরও কিছু সমস্যা ছিল। কিন্তু গড়িমসি করেছেন ডাক্তার দেখাতে। এ বার তিনিও পরীক্ষা করাতে শুরু করলেন। তাতে হয়তো তাঁরও ক্যানসার হয়েছে জানা গেল। তখন মনে হবে, স্বামী-স্ত্রী দু’জনের একই সময়ে এই রোগ হয়েছে।