সমতলে নামতে জীবনপণ

গত বৃহস্পতিবার মোর্চার ডাকে অনির্দিষ্ট কালের বন্‌ধ শুরু হয়। বেসরকারি পরিবহণ তো দূরের কথা, তিন দিন সরকারি বাসও চলেনি। তাই ভোরের পাহাড়ে দুধ, জল, সংবাদপত্র বা পুলিশের গাড়িতে উঠে কোনও ক্রমে শিলিগুড়ি পৌঁছনোর চেষ্টা এখন পরিচিত ছবি।

Advertisement

কৌশিক চৌধুরী ও সৌমিত্র কুণ্ডু

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০১৭ ০২:২৫
Share:

ফেরা: দীর্ঘ অপেক্ষার পর বাস। ছবি: সৌমিত্র কুণ্ডু

বিহারের ছাপরার বাসিন্দা নীতীশ প্রসাদ, প্রথম বর্যের ছাত্র। ভাই রীতেশ স্কুলে পড়ে। গরমের ছুটিতে মামার কাছে ঘুরতে এসেছিলেন। ঘুমে বাড়ি মামা মনোহরের। এ বার বাড়ি ফেরার পালা। কিন্তু গত তিন দিন ধরে দুই ভাগ্নেকে কোনও ভাবেই গাড়িতে তুলে দিতে পারেননি মামা। সোমবারও ভোরে ৮ কিমি হেঁটে চকবাজারে আসেন গাড়ির খোঁজে।

Advertisement

দিল্লিতে ম্যানেজমেন্টের পরীক্ষা রয়েছে লেবং-এর বাসিন্দা রিকসমের। ভোররাতে বন্ধুর বাইকে চকবাজারে পৌঁছন। শিলিগুড়ির যাওয়ার জন্য চেষ্টা করছিলেন তিনিও। একই অবস্থা মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা অঙ্কিত শাহর। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী অঙ্কিত। ক’দিন আগে সমতলে বদলি হলেও নামতে পারছিলেন না নীচে। এ দিন ভোর সাড়ে ৪টেয় তিনিও হাজির হয়ে যান চকবাজারে। শুধু অঙ্কিত বা নীতীশ নয়, প্রতিদিনই পাহাড়ের অন্তত শ’খানেক বাসিন্দা সমতলে নামার প্রয়োজনে ভোররাতে জড়ো হয়ে যাচ্ছেন চকবাজারে।

গত বৃহস্পতিবার মোর্চার ডাকে অনির্দিষ্ট কালের বন্‌ধ শুরু হয়। বেসরকারি পরিবহণ তো দূরের কথা, তিন দিন সরকারি বাসও চলেনি। তাই ভোরের পাহাড়ে দুধ, জল, সংবাদপত্র বা পুলিশের গাড়িতে উঠে কোনও ক্রমে শিলিগুড়ি পৌঁছনোর চেষ্টা এখন পরিচিত ছবি।

Advertisement

বহু অনুরোধে কখনও কখনও কাউকে গাড়িতে তুলে নিচ্ছেন চালকরা। আবার কখনও রাস্তায় বিক্ষোভের ভয়ে প্রত্যাখান করছেন। তাই প্রতি ভোরেই চলছে ছোট গাড়ি ধরার লড়াই। অনেক নির্মাণ শ্রমিকও কোনও উপায় না পেয়ে হেঁটেই রওনা হয়েছেন শিলিগুড়ির দিকে। বরাত জোরে মাঝপথে অনেকে গাড়ি পেয়েছেন। অনেকেই পাননি। এমন বহু যুবককে রোজ পাহাড় থেকে হেঁটে নামতে দেখা যাচ্ছে।

এ দিনও ভোর ৪টে বাজতে না বাজতে সরগরম হয়ে ওঠে চকবাজার। একের পর এক চারটি বেসরকারি বাস দেখে চিৎকার চেঁচামেচি, দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। মিনিটের দশেকের মধ্যে ভুল ভাঙে সবার। জেলা হাসপাতালের পাশে থাকা সদর থানা থেকে নেমে আসতে থাকেন কয়েকশো পুলিশ কর্মী। তাঁদের নিয়ে যেতেই বাস। পাশাপাশি জলের গাড়ি, দুধের গাড়ি বা সংবাদপত্রের গাড়িতে ওঠার জন্য প্রতিযোগিতা চলে। প্রতিটি ছোট গাড়ি আসা মাত্র তাকে ঘিরে ভিড়। শিলিগুড়ি-দার্জিলিং ছোট গাড়ির ভাড়া ১৩০ টাকা। সমতলে নামতে অনেকেই পাঁচশো- হাজার টাকার প্রস্তাব দেন। গাড়ি চালক বিনোদ গজমের বলেন, ‘‘প্রাণ হাতে চলছি। অন্যদের কী ভাবে ঝামেলায় ফেলি।’’

সোমবার সন্ধেয় দার্জিলিঙের চক বাজার থেকে ১০ বছরের ছেলে প্যাট্রিককে নিয়ে যখন বাসে উঠলেন তখন কেঁদে ফেললেন মা ময়া থামি। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন বাবা প্রশান্তবাবু। এ দিন সরকারি বাস পাঠানো হচ্ছে শুনে ভোর থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা। শিলিগুড়ি থেকে বেলা সাড়ে ৯টা নাগাদ রওনা হয়ে বাস এসে যখন পৌঁছল তখন সন্ধ্যা ছ’টা। তখনও কয়েকশো যাত্রী বাসের অপেক্ষায়। উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার পাঁচটি বাস পুলিশি নিরাপত্তায় এ দিন পাহাড়ে পৌঁছেছে। কে জায়গা পাবে আর কে পাবেন না তা অনিশ্চিত। তবু লাইন ছেড়ে যাননি কেউ। খাওয়া বলতে সঙ্গে থাকা বিস্কুট, ফল। বৃষ্টি নামলে ছাতা খোলেন কেউ। কেউ বা বৃষ্টিতে ভিজতে থাকেন নাগাড়ে। ফেরার বাসে উঠতে পেরে অনেকের চোখেই জল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement