শিশু পণ্য

ডলার, ইউরো, সোনার মুদ্রা, গয়না, হাড়গোড় আর ১০ শিশুকন্যা উদ্ধার

তদন্ত যত এগোচ্ছে, চমকে উঠছেন গোয়েন্দারাই! বাদুড়িয়ায় তিন সদ্যোজাতকে উদ্ধার দিয়ে যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, কলকাতার দু’টি নার্সিংহোম ঘুরে আপাতত তা কেন্দ্রীভূত হল দক্ষিণ শহরতলিতে মানসিক প্রতিবন্ধীদের একটি হোমে।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক ও অরুণাক্ষ ভট্টাচার্য

কলকাতা ও হাবরা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৫৩
Share:

‘পূর্বাশা’ থেকে উদ্ধার হওয়া শিশু কোলে তদন্তকারী অফিসারেরা। শুক্রবার ঠাকুরপুকুরে। —নিজস্ব চিত্র।

তদন্ত যত এগোচ্ছে, চমকে উঠছেন গোয়েন্দারাই!

Advertisement

বাদুড়িয়ায় তিন সদ্যোজাতকে উদ্ধার দিয়ে যে তদন্ত শুরু হয়েছিল, কলকাতার দু’টি নার্সিংহোম ঘুরে আপাতত তা কেন্দ্রীভূত হল দক্ষিণ শহরতলিতে মানসিক প্রতিবন্ধীদের একটি হোমে।

শুক্রবার ভোররাতে ঠাকুরপুকুরের ‘পূর্বাশা’ নামে ওই হোমটি থেকে এক থেকে দশ মাসের ১০টি শিশুকন্যাকে উদ্ধার করল সিআইডি। বেশির ভাগই পড়ে ছিল মেঝেতে কাপড়ের উপরে। কোনওটি আবার কাপড়ের দোলনায়। আর তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাবরার মছলন্দপুরের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর পিছনের মাঠ খুঁড়ে দুই শিশুর দেহাবশেষও পেলেন গোয়েন্দারা। কলকাতার শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের মালিক, চিকিৎসক পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হেফাজতে পাওয়া গেল ২০০০ ইউরো, ১০৬০ মার্কিন ডলার, ২০০ হংকং ডলার, ১০ গ্রাম করে ওজনের ১০টি সোনার কয়েন এবং লক্ষাধিক টাকার গয়না। যা থেকে শিশু পাচারে বিদেশ যোগের সম্ভাবনাও মজবুত হল বলে মত গোয়েন্দাদের।

Advertisement

পাচারের জন্য শিশুদের এনে রাখার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে ‘পূর্বাশা’র মালকিন রিনা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাদুড়িয়া কাণ্ডের অন্যতম অভিযুক্ত পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায়েরই মেয়ে রিনা। পুতুল শিশু পাচারের কারবারে মেয়েকেও নামিয়েছিল বলে মত তদন্তকারীদের। এই নিয়ে গত চার দিনে উদ্ধার হল ১৩টি সদ্যোজাত। শিশু পাচার কাণ্ডের জাল যে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়ানো রয়েছে, সে ব্যাপারে গোয়েন্দারা এখন এক রকম নিশ্চিত। তাঁদের দাবি, রিনা শিশু পাচারের কথা কবুল করেছে। প্রতিটি শিশু সে ৬-৭ লক্ষ টাকায় পাচার করত বলে জেরায় জানিয়েছে।

এতগুলি বিভিন্ন বয়সের কন্যাসন্তান এক জায়গা থেকে পাওয়ায় উঠছে অন্য প্রশ্নও। ক্রেতা পেতে সমস্যা হওয়াতেই কি এতগুলি শিশুকে এ ভাবে এক জায়গায় অযত্নে ফেলে রাখা হয়েছিল? বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন গোয়েন্দারা।

এডিজি সিআইডি রাজেশ কুমার জানান, তদন্তের ক্রমশ জাল ছড়িয়ে পড়ছে। আরও অনেক তথ্য মিলছে। তল্লাশি চলবে। এ দিন ফলতার একটি হোমেও তল্লাশি চলে। সেখানে কিছু পাওয়া যায়নি। রাজ্যের শিশু ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজা জানান, কোথা থেকে এবং কী ভাবে শিশুগুলি ঠাকুরপুকুরের হোমে এল তা দফতরের পক্ষ থেকেও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

কী করে জানা গেল ঠাকুরপুকুরের ওই হোমের কথা?

বৃহস্পতিবারের বারবেলায় বেজে উঠেছিল এক সিআইডি কর্তার ল্যান্ডলাইন। ফোনের ও প্রান্ত থেকে এক জন জানান, ‘ঠাকুরপুকুরের হাঁসখালি এলাকার তিনতলা ‘পূর্বাশা’ বাড়িতে মাঝেমধ্যেই শিশু এনে রাখা হয়। আপনারা খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন’। এতেই সন্দেহ দানা বাঁধে তদন্তকারীদের। কারণ, আগের রাতে বেহালার সাউথ ভিউ নার্সিংহোমের মালিক পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায়কে জেরা করে জানা গিয়েছিল, ঠাকুরপুকুরে একটি মানসিক প্রতিবন্ধীদের হোম চালায় তার মেয়ে। দু’য়ে দু’য়ে চার করেন তদন্তকারীরা। শুক্রবার ভোররাতে তাঁরা ‘পূর্বাশা’য় হানা দেন।

সিআইডি সূত্রের খবর, হোমের একতলায় পুরুষ মানসিক রোগী এবং দোতলায় মহিলা মানসিক রোগীদের রাখা হয়। এক থেকে দশ মাস বয়সের শিশুগুলি রাখা ছিল হোমের তিনতলার একটি ঘরে। তাদের প্রথমেই একটি অ্যাম্বুল্যান্সে তুলে ঠাকুরপুকুর ইএসআই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। নীচের একটি ঘর থেকে ধরা হয় হোমের মালিক রিনাকে। শিশুগুলিকে দেখভাল করতেন এক মহিলা। তাঁকে সিআইডি আটক করেছে। তদন্তকারীরা জানান, জেরায় ওই মহিলা দাবি করেছেন, গত ১০ নভেম্বর স্থানীয় একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুই সদস্য শিশুগুলিকে নিয়ে আসে। এই কথার ভিত্তিতে শুক্রবার গভীর রাতে

বিমল অধিকারী নামে এক জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তিনি ‘মিলেনিয়াম ওল্ড এজ রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার’ নামে ঠাকুরপুকুর জোকা এলাকার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার। তদন্তকারীদের দাবি, বিমল ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় শিশু কিনতেন। তার পর ১ থেকে ৬ লাখ টাকায় বিক্রি করতেন নিঃসন্তান দম্পতিদের কাছে।

এ দিন আটক করা হয়েছে হোমের এক নার্সকেও। এ দিন রিনাকে প্রথমে বসিরহাট আদালতে হাজির করানো হয়। বিচারক তাকে ১১ দিন সিআইডি হেফাজতের নির্দেশ দেন। আদালত চত্বরে রিনা দাবি করে, ‘‘স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দুই সদস্যই শিশুদের হোমে নিয়ে আসে। আমি চক্রান্তের শিকার।’’

এ দিন মছলন্দপুরেও সাফল্য পায় সিআইডি। সেখানকার ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট’-এর জমির মাটি খুঁড়ে মিলেছে দু’টি শিশুর দেহাবশেষ। এক জনের দেহের হাড়গোড় গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। অন্য জনের দেহাবশেষের সঙ্গে ‘মেক্সিকো’ লেখা একটি ছেঁড়াখোঁড়া গেঞ্জি মিলেছে। তদন্তে যা গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে, জানাচ্ছেন এক সিআইডি কর্তা। দেহাবশেষ যখন তুলে আনা হচ্ছে, তখনও নির্বিকার মুখে পাশে দাঁড়িয়ে পাচার চক্রের কুশীলব পলি দত্ত, সত্যজিৎ সিংহরা। দেহাবশেষ উদ্ধারের পরে ট্রাস্টের ঘর থেকে পাওয়া বিস্কুটের পেটিতে রেখেই ময়না-তদন্তের জন্য পাঠানো হয় কলকাতার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। গালা দিয়ে এঁটে দেওয়া হয় বাক্সের মাথা।

সিআইডি কর্তাদের অনুমান, একটি শিশু সম্ভবত সময়ের আগে জন্মানোয় পৃথিবীর আলোই দেখেনি। অন্যটি জন্মের তিন-চার দিনের মধ্যে মারা যায়। দু’টি দেহই বছর খানেকের মধ্যে পোঁতা হয়েছিল। পলির কাছ থেকে সিআইডি জানতে পেরেছে, তার হাতে শাঁসালো খদ্দের ছিল। বরাত পেয়েই তারা কাজে নেমে পড়ে। পলির কাছে স্থানীয় এক মহিলার খোঁজ ছিল। মহিলা ওই সময়ে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। গোয়েন্দাদের পলি জানায়, মোটা টাকা হাতছাড়া হয়ে যাবে ভেবেই ওই মহিলাকে প্রসবে রাজি করায় তারা। কিন্তু শিশুটিকে বাঁচানো যায়নি। দ্বিতীয় শিশুটি কোথা থেকে এল? জেরায় জানা গিয়েছে, কলকাতা থেকে পাচারের সময়ে পথের ধকল সহ্য করতে না পেরে শিশুটি মারা যায়। দু’টি শিশুকেই কবর দেওয়া হয় ট্রাস্টের জমিতেই।

এ দিন পলিদের সঙ্গে আনা হয়েছিল মাসুদা বিবি নামে ধৃত আরও এক জনকেও। ওই মহিলাকে দিয়েই মৃত শিশু বা ভ্রূণ মাটিতে পুঁতে ফেলত পলিরা, জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তাঁরা মনে করছেন, এই কাণ্ডে আরও অনেক চমক অপেক্ষা করে রয়েছে। তদন্তের দ্রুত অগ্রগতির জন্য বিভাগীয় পুরস্কার দেওয়া হয়েছে সিআইডি-র দুই অফিসার সৌগত ঘোষ এবং কাকলি ঘোষকে।

—নিজস্ব চিত্র

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন