State news

শিশু পাচার: নজরে আরও অনেক নার্সিংহোম এবং চিকিত্সক

কলকাতা থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে যে এমন একটা ভয়ানক চক্র চলে, জানার পর হতবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু বাদুড়িয়ায় শিশু পাচার চক্রের হদিশ পাওয়ার দিনও স্পষ্ট ছিল না, জানার এবং হতবাক হওয়ার অনেক কিছু বাকি আছে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ১৯:০৭
Share:

উদ্ধার হওয়া শিশু। নিজস্ব চিত্র।

কলকাতা থেকে মাত্র ৬০ কিলোমিটারের মধ্যে যে এমন একটা ভয়ানক চক্র চলে, জানার পর হতবাক হয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু বাদুড়িয়ায় শিশু পাচার চক্রের হদিশ পাওয়ার দিনও স্পষ্ট ছিল না, জানার এবং হতবাক হওয়ার অনেক কিছু বাকি আছে। বাদুড়িয়াতে যে জালের একটা প্রান্ত ধরা পড়েছিল, সেই জাল টানতে গিয়ে একে একে চলে এল মছলন্দপুর, বেহালা, ঠাকুরপুকুর তো বটেই, টান পড়ল খাস কলকাতার কেন্দ্রস্থলেও। এখনও বোধহয় পরিষ্কার নয়, আরও কত জায়গা, আরও কত জন এই জালে জড়িত।

Advertisement

বেশ কয়েক দিন ধরেই রাজ্যের গোয়েন্দাদের কাছে খবরটা আসছিল। উত্তর ২৪ পরগনার বাদুড়িয়া, বেড়াচাঁপা, হাবরা, হাড়োয়া, দুর্গানগর এবং দমদম থেকে নারী পাচারের পাশাপাশি শিশু পাচারও নাকি রমরমিয়ে চলছে। তাঁরা জানতে পারেন ওই সব এলাকায় বেশ কিছু নার্সিংহোম, ক্লিনিক এবং দোকানকে সামনে রেখে চলছে এই শিশু পাচারের ব্যবসা। কারা কারা এই পাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত, নজর রাখতে গিয়েই সিআইডির চোখ পড়ে বাদুড়িয়ার যদুরহাটি হাসপাতালের মোড়ে বৈদ্য ক্লিনিকের মালিক নাজমা বিবির দিকে। নাজমাই বলা যেতে পারে সিআইডি সাফল্যের প্রথম ধাপ।

বিশাল বাড়ির নীচতলায় ওই ক্লিনিক খুলে বসেছিল নাজমা। এলাকায় হাতুড়ে হিসাবেও পরিচিত ছিল সে। বাগজোলা বাজারে এক চিকিৎসকের সহযোগী হিসাবে কাজের সুবাদে ক্রমে ক্রমে নানা ব্যাপারে হাত পাকিয়েছিল সে। দেগঙ্গার এক চিকিৎসকের কাছেও কিছু দিন কাজ করে। সেই সূত্রে যোগাযোগ তৈরি হয় বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, নার্সিংহোমের সঙ্গেও। এই কাজের সুবাদেই পরিচয় হয় শ্রীরামপুরের মুহুরিপাড়ার বাসিন্দা বাকবুলের। বিয়েও হয় ২০০৮ সালে। ক্লিনিক চালানোর পাশাপাশি স্বামী-স্ত্রী বাগজোলায় ‘সোহান’ নামে একটি নার্সিংহোমের দেখাশোনা শুরু করে। গোয়েন্দারা নাজমার সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ্য করেই ‘সোহান’ নার্সিংহোমের সন্ধান পান। গোয়েন্দাদের কাছে ওই নার্সিং হোম থেকে শিশুপাচারের অভিযোগ আসছিল। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে গত ২১ নভেম্বর সেখান থেকে তিন সদ্যোজাতকে উদ্ধার করেন তদন্তকারীরা। নাজমা-সহ আট জনকে গ্রেফতার করা হয়। এখানেই যে পাচার চক্র থেমে নেই, গোয়েন্দারা সেটা টের পান সোহান-এর মালিক আসাদুর জামানকে গ্রেফতার এবং জেরা করার পর।

Advertisement

নাম উঠে আসে মছলন্দপুরের ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’-এর আধিকারিক অতিক্রম ব্যাপারীর। গোয়েন্দারা ওই ব্যক্তির দমদমের বাড়িতে হানা দেন। সেখান থেকে গ্রেফতার করা হয় অতিক্রমের স্ত্রী পলি দত্ত ওরফে উত্পলা ব্যাপারীকে। এই মহিলা হলেন প্রয়াত জাহাজ কর্মী সুজিত দত্তের মেয়ে। বাবার নামেই মছলন্দপুরে বিশাল জমিতে পলি দত্ত গড়ে তুলেছিলেন ‘সুজিত দত্ত মেমোরিয়াল ট্রাস্ট’। ট্রাস্টের ঘোষিত কাজ ছিল প্রতি সপ্তাহে এক দিন অসুস্থ, দরিদ্র মানুষদের বিনা খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এ ছাড়া, প্রতি দিন বিকেলে এলাকার দুঃস্থ মেধাবী শিশুদের পড়াশোনা করানো। কিন্তু সেই ‘চ্যারিটেবল’ কাজের পিছনেই চলত শিশু পাচার চক্র। বিভিন্ন জায়গা থেকে ভবঘুরে প্রসূতিদের ধরে নিয়ে এসে প্রসব করিয়ে সদ্যোজাতকে চড়া দামে দেশ-বিদেশে বিক্রি করে দেওয়া হতো। এখানে মহিলাদের গর্ভপাতও করানো হত বলে জানা গিয়েছে। কোনও জটিল কেস হলে সোজা নিয়ে যাওয়া হত সোহান নার্সিংহোমে। উত্পলা ব্যাপারীকে জেরা করে শিশু পাচারের আরও নয়া তথ্য হাতে আসে গোয়েন্দাদের। শুধু শহরতলি নয়, কলকাতারও কয়েকটি নার্সিংহোমের নাম জড়িয়ে পড়ে শিশু পাচারের সঙ্গে। তার মধ্যে বেহালার সাউথ ভিউ, উত্তর কলকাতার মহাত্মা গাঁধী রোডের শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোম।

সেই সূত্র ধরেই সাউথ ভিউ নার্সিংহোমের মালকিন ‘বড়দি’ ওরফে পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়। শ্রীকৃষ্ণ নার্সিংহোমের হদিস পেয়ে যখন সেখানে হানা দেন গোয়েন্দারা, জানতে পারেন এই পাচার কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নার্সিংহোমেরই চিকিত্সক সন্তোষ সামন্ত। পাচারের জালে যখন চিকিত্সকের জড়িয়ে থাকার বিষয়টি সামনে আসে, আরও জোরকদমে তদন্তে নামেন গোয়েন্দারা। আর কোনও চিকিত্সক এ চক্রে জড়িত কিনা খতিয়ে দেখতে গিয়ে গাইঘাটার হাতুড়ে চিকিত্সক তপন বিশ্বাসের নাম সামনে আসে। গ্রামবাসীদের অনেকে জানান, স্থানীয় এক চিকিৎসকের সহকারী হিসাবে এক সময়ে কাজ করত তপন। পরে নিজেই প্র্যাকটিস শুরু করে। দশ-বারো বছর আগেও গ্রামের যে যুবক সামান্য হাতুড়ে চিকিৎসক হিসাবে জ্বর-সর্দি-কাশির মতো সাধারণ রোগের চিকিৎসা করত, সে কী ভাবে রাতারাতি এত টাকা কামালো। কালো কাচে ঢাকা বিশাল বাড়ি, একাধিক গাড়ি, ঠাটবাট— সবই নাকি বদলে গিয়েছিল তপনের। গ্রামের এক যুবকের কথায়, ‘‘কোনও কারণে কেস নিজে সামলাতে না পারলে প্রসূতিদের বাদুড়িয়ার ওই নার্সিংহোমে নিয়ে যেত তপনদা।’’ তা ছাড়া, এলাকার কিছু গাড়ি চালকের সঙ্গে তপনের চুক্তি ছিল। তার কাছে আসা রোগীদের বাদুড়িয়ায় পৌঁছে দিলে ওই গাড়ি চালকদের থেকে কমিশন নিত তপন।

এরই মধ্যে ‘পূর্বাশা’ নামে ঠাকুরপুকুরের এক হোম থেকে ১০টি শিশুকন্যাকে উদ্ধার করে সিআইডি। উদ্ধার হওয়া শিশুদের বয়েস এক থেকে দশ মাস। গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার গভীর রাতে বাখরাহাট রোডের কলাগাছিয়ার ওই হোমে হানা দেয় সিআইডি। হোমের তিনতলার একটি ঘর থেকে ওই শিশুদের উদ্ধার করা হয়। এই পূর্বাশা হোমের মালিক আবার পুতুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে রিনা বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাদুড়িয়ার সোহান নার্সিংহোম এবং সুজিত মেমোরিয়ালের সঙ্গে যুক্ত মাসুদা বিবি নামে এক মহিলাকে জেরা করে গোয়েন্দারা জানতে পারেন, সুজিত মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অফিসের পিছনের মাঠে বেশ কিছু শিশুর দেহ পুঁতে রাখা আছে। শুক্রবার মছলন্দপুরে গিয়ে সেকান থেকে দু’টি শিশুর কঙ্কাল উদ্ধার করে গোয়েন্দারা।

যে ভাবে শহরতলি থেকে শহরের বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম এই কাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে গোয়েন্দাদের ধারণা আরও তলিয়ে দেখলে অনেক নার্সিংহোমই পাচারকাণ্ডের তালিকায় উঠে আসবে। এ ছাড়া চিকিত্সকের এই ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়টিও কম আশঙ্কার নয়। যে দিকে তদন্ত এগোচ্ছে, তাতে আর বেশি হয়ত অপেক্ষা করতে হবে না যে অনেক কেউটেই জালে ধরা পড়বে। নজর রাখা হয়েছে বেশ কয়েকটি নার্সিংহোম এবং চিকিত্সকের উপর।

আরও খবর...

পাচারের জন্য রাখা ১০ শিশু উদ্ধার ঠাকুরপুকুরের হোমে, ধৃত মালকিন

মাটি খুঁড়তেই বেরিয়ে আসছে শিশুদের হাড়গোড়, কঙ্কাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন