একে ভাঁড়ারে টান। তার উপরে যাত্রী-পরিষেবা নিয়ে নিত্যদিনের অভিযোগ-অনুযোগ। তারও উপরে রেলের চিন্তা বাড়িয়েই চলেছে রক্ষিবিহীন হাজারো লেভেল ক্রসিং।
রেল মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী গোটা দেশে ২৮ হাজার ৫৯২টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে। তার মধ্যে এখন পাহারার ব্যবস্থা আছে ১৯ হাজার ২৫২টিতে। বাকি ৯৩৪০টিতে কোনও প্রহরীই নেই। নেই নিরাপত্তার বিকল্প ব্যবস্থাও। রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, ভারতীয় রেলে বছরে মোট দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশই ঘটে রক্ষিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে। আবার প্রতি বছর রেল-দুর্ঘটনায় মৃতদের ৪০ শতাংশই প্রাণ হারান বিনা প্রহরার লেভেল ক্রসিংয়ে লাইন পেরোতে গিয়েই। অর্থাৎ রেল-দুর্ঘটনার সংখ্যা এবং রেল-দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা, দু’টি ক্ষেত্রেই দায় বেশি রক্ষিহীন লেভেল ক্রসিংয়ের। অঙ্কের হিসেবে দু’টিই আপাতত ৪০ শতাংশ। এটাই মাথাব্যথা বাড়িয়েছে রেলের।
অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়ে অসতর্ক চলাচলই বিপদ ডেকে আনে। রেল সূত্রের খবর, শুধু লেভেল ক্রসিং নয়, গোটা দেশে রেললাইন পারাপার করতে গিয়ে রোজ গড়ে ৮০০ মানুষ কাটা পড়েন। শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, শহরের লেভেল ক্রসিংয়ে গেটম্যানকে উপেক্ষা করে অনেকেই রেললাইনে ঢুকে পড়ে মৃত্যুর মুখে পড়ছেন। সমস্যা জটিল হচ্ছে মোবাইলের অতি ব্যবহারে। কানে হেডফোন গুঁজে বা মোবাইলে কথা বলতে বলতে পথ চলেন অনেকেই। রেললাইন পেরোনোর সময়েও তাঁরা মোবাইলে এমনই মগ্ন থাকেন যে, অন্য কিছুই তাঁদের চোখে পড়ে না। বিপদের পদধ্বনি তাঁদের কানেও ঢোকে না।
সতর্কতা-সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নানা ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া হচ্ছে। মাইকে ঘোষণা চলেছে সমানে। মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়েও হুঁশিয়ার করে দেওয়া হচ্ছে। অনেক জায়গায় নিয়োগ করা হয়েছে রেলমিত্র। কিন্তু তাতেও প্রহরা-বিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঠেকাতে পারছেন না রেল-কর্তৃপক্ষ। বাড়ছে দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যাও।
দুর্ঘটনা রুখতে এ বার ঢালাও নির্মাণকাজ শুরু করেছে রেল মন্ত্রক। ঠিক হয়েছে, প্রহরা-বিহীন লেভেল ক্রসিংগুলিতে গড়া হবে উড়ালপুল। তার বিকল্প হিসেবে যে-সব জায়গায় সুযোগ-সুবিধে আছে, সেখানে আন্ডারপাসও তৈরি করা হবে। আর রক্ষী নিয়োগের ব্যবস্থা তো থাকছেই। নির্মাণ প্রকল্পগুলির কাজ শেষ করা হবে তিন বছরের মধ্যে।
কয়েক বছর ধরেই রেল-কর্তৃপক্ষ এই বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছিলেন। চলতি বছরে রেল মন্ত্রক এ ব্যাপারে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণ করায় ওই কাজে গতি এসেছে বলে রেলের দাবি। ভারত জুড়ে সব রেল জোনেই রক্ষিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে প্রহরা বসানোর কাজ শুরু হয়েছে। রেলকর্তারা জানান, যে-সব ক্ষেত্রে প্রহরা বসানো যাবে না, সেখানে রেলের পক্ষ থেকেই তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে উড়ালপুল বা আন্ডারপাস। এগুলোর কোনওটাই করতে না-পারলে নিয়োগ করা হচ্ছে ‘রেলমিত্র’। এই ধরনের রেল-বন্ধুরা ট্রেন আসার আগে লাইন পারাপারের ব্যাপারে মানুষকে সতর্ক করে দেবেন। এ ছাড়া প্রতিটি রেলগেটে বড় বড় করে হোর্ডিং লাগানো হচ্ছে। যাতে লাইন পারাপারের আগে মানুষ হোর্ডিং দেখে এক মিনিট দাঁড়িয়ে যান।
রক্ষিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে পাহারা বসালে দুর্ঘটনা কমে যাবে বলে আশা করছে রেল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, প্রহরী আছেন, লেভেল ক্রসিং বন্ধও আছে। তবু জোর করে ঢুকে লাইন পেরোতে গিয়ে প্রতিদিন মানুষ কাটা পড়ছেন। এটা কী ভাবে বন্ধ করা যাবে?
রেলকর্তারা বলছেন, এই বিষয়েও ভাবনাচিন্তা চলছে। সামগ্রিক সতর্কতার বিচারে পূর্ব রেলের আসানসোল ডিভিশন এগিয়ে রয়েছে বলে রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর। এই ডিভিশনে আর কোনও প্রহরা-বিহীন লেভেল ক্রসিং নেই। রেল মন্ত্রক এই ডিভিশনকেই ‘মডেল ডিভিশন’ ঘোষণা করে প্রচারে নামছে। গত দু’বছরে দক্ষিণ-পূর্ব রেলে প্রহরা-বিহীন লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে দু’টি। মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। মাত্র দু’টি দুর্ঘটনায় এত বেশি প্রাণহানির কারণ, ক্রসিংয়ে ট্রেনের মুখে পড়ে গিয়েছিল যাত্রী-বোঝাই গাড়ি। পূর্ব রেলের ক্রসিংয়ে ওই একই সময়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে দু’টি। মৃত্যুর খবর নেই।
দক্ষিণ-পূর্ব রেলের কর্তারা জানান, ২০১৬-’১৭ সালের মধ্যে ১৮৫টি রক্ষিবিহীন ক্রসিংয়ের কয়েকটিতে উড়ালপুল বা আন্ডারপাস গড়ে দেওয়া হবে। কয়েকটির ক্ষেত্রে লাইনের উপর দিয়ে যাতায়াতের রাস্তা ঘুরিয়ে দেওয়া হবে এবং সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হবে দু’টি ক্রসিং। পূর্ব রেলের আসানসোল ছাড়া অন্যান্য ডিভিশনে এখনও ৩৫টি ক্রসিংয়ে প্রহরী বা অন্য সুরক্ষা ব্যবস্থা করা যায়নি। সেগুলিতেও নিরাপত্তার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দু’বছরের মধ্যে সব ক’টি অরক্ষিত লেভেল ক্রসিংয়েই প্রহরী বসিয়ে দেওয়া হবে বা অন্য ভাবে সুরক্ষার ব্যবস্থা হবে।