গুজবে ইতি নেই। ছেদ পড়েনি তার জেরে অপ্রীতিকর ঘটনাতেও। গত ক’দিনের ঘটনার রেশে টেনে সোমবারও বর্ধমানের মন্তেশ্বরে ছেলেধরা সন্দেহে হেনস্থা করা হয়েছে এক তরুণীকে। কালনায় ছাগল চোর সন্দেহে আটক করা হয় দুই মোটরবাইক আরোহীকে। এই পরিস্থিতিতে যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করলেন রাজ্য পুলিশের ডিজি সুরজিৎ করপুরকায়স্থ। গুজব ছড়ানো ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটা বন্ধ করতে বুথ স্তর পর্যন্ত দলীয় কর্মীদের পথে নামানোর আশ্বাস দিয়েছেন তৃণমূল নেতৃত্বও।
অস্থিরতা তৈরির লক্ষ্যে কিছু লোক গুজব ছড়াচ্ছে বলে দাবি করে সোমবার ডিজি বলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত রাজ্য জুড়ে ২৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গুজব ছড়ানোয় যারা ইন্ধন দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেব।’’ রাজ্য পুলিশ ও কলকাতা পুলিশ এক সঙ্গে পরিস্থিতির মোকাবিলা করবে বলে তিনি জানান।
পুলিশ সূত্রের খবর, বেশ কিছু দিন ধরে ‘ফেসবুক’ ও ‘হোয়াটসঅ্যাপ’-এ এই মর্মে কিছু ‘পোস্ট’ বা ‘মেসেজ’ ছড়াচ্ছে যে— বিভিন্ন এলাকায় ছেলেধরা, জঙ্গি বা ডাকাতেরা ঘুরছে। বাড়িতে ঢুকে তারা মহিলাদের শ্লীলতাহানিও করছে। মেসেজ বা পোস্টের মূল বক্তব্য, ‘ওই সব অপরিচিত লোকেদের থেকে সাবধান হন। বাচ্চাদের সাবধানে রাখুন।’
এই গুজবের জেরে উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া, বর্ধমান ও হুগলির একাংশে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। বর্ধমানের কালনায় ছেলেধরা গুজবের জেরে গণপিটুনিতে প্রাণ গিয়েছে এক কীটনাশক বিক্রেতার। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটায় এক প্রৌঢ়াকে ছেলেধরা সন্দেহে মারধর করে জনতা। জঙ্গি সন্দেহে হাবরায় এক মানসিক ভারসাম্যহীনকে এবং নদিয়ার হরিণঘাটায় হাবড়ার তিন ব্যবসায়ীকে ডাকাত সন্দেহে পেটানো হয়। শনিবার হুগলির বলাগড়ে শিশুচোর সন্দেহে জনতার হাতে আক্রান্ত হন কল্যাণীর স্কুলশিক্ষিকা অপর্ণা ঘোষ এবং তাঁর বৃদ্ধা মা। মারধর করে আগুন লাগানো হয় তাঁদের গাড়িতে। সেই ঘটনার জেরে এখনও সিঁটিয়ে রয়েছেন অপর্ণার মা রঞ্জুবালাদেবী। তাঁর ছেলে কৌশিক ঘোষ এ দিন বলেন, ‘‘বাড়ির সামনে জটলা দেখলে মা ভয়ে সিঁটিয়ে যাচ্ছেন। ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়াতে হয়েছে তাঁকে।’’
সোমবার প্রায় একই ধরনের ঘটনার হাত থেকে কোনও মতে বেঁচে গিয়েছেন এক তরুণী। এ দিন সকালে বর্ধমানের মন্তেশ্বরের রায়গ্রাম এলাকায় একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য চাঁদা তুলতে গিয়েছিলেন তিনি। সঙ্গে বৈধ কাগজপত্র থাকলেও ছেলেধরা বলে তাঁকে ঘিরে ধরে এলাকার কয়েকজন। খবর পেয়ে তাঁকে উদ্ধার করেন তৃণমূলের পঞ্চায়েত প্রধান। এই ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই কালনা ১ ব্লকের রুস্তমপুর এলাকায় গুজবের জেরে ছাগলচোর সন্দেহে দুই মোটরবাইক আরোহীকে তাড়া করে আটকায় জনতা। মারধরের তোড়জো়ড় হলেও স্থানীয় এক তৃণমূল নেতা তাঁদের উদ্ধার করেন।
গুজব-পরিস্থিতি যেখানে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে, সেখানে মোকাবিলায় প্রশাসন কতটা তৈরি?
রাজ্য পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, যে সব জেলায় ইতিমধ্যেই গুজবের জেরে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, সেখানে প্রতিটি থানাকে বাড়তি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পুলিশ মাইক নিয়ে গুজবে কান না-দিতে প্রচার করছে। বর্ধমানে এসডিপিও, বিডিও-রা ‘হোয়াটস অ্যাপ’-এর বিভিন্ন গ্রুপে গুজবে কান না-দেওয়ার কথা বলে ‘পোস্ট’ করছেন।
পঞ্চায়েত প্রতিনিধিরা গ্রামে গ্রামে প্রচার করছেন। লিফলেট ছড়ানো এবং পোস্টারও সাঁটা হচ্ছে। এলাকার বিভিন্ন ক্লাব এবং নৈশরক্ষী বাহিনীগুলিকে সামিল হয়েছে সচেতনতা-প্রচারে। টোটোয় মাইক নিয়ে ঘুরে ঘুরে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কিছু বেসরকারি সংস্থাকে। স্কুল, ক্লাব, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্যরাও মিছিল করে এলাকায় এলাকায় লিফলেট বিলি করছেন। বলাগড়ে সর্বদল বৈঠক করে সচেতনতা প্রচারে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে গুজব-বিরোধী প্রচারে পঞ্চায়েত কর্মীদের ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে বসে নেই শাসক দলও। তৃণমূলের অন্যতম শীর্ষ নেতা মুকুল রায়ের কথায়, ‘‘বুথ থেকে রাজ্য স্তর পর্যন্ত আমাদের দলের কর্মীরা মানুষের পাশে রয়েছেন। গুজব নিয়ে মানুষের ভুল ভাঙাতে তাঁদের ব্যবহার করা হবে।’’
বর্ধমানের তৃণমূল নেতা তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ জানাচ্ছেন, গ্রামীণ বর্ধমানে অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, শিক্ষক-শিক্ষিকা, বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যদের গুজবের বিরুদ্ধে প্রচারে মাঠে নামতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘‘জেলায় দলের জনপ্রতিনিধিরা প্রতিদিন যেখানে, যে অনুষ্ঠানে যাবেন, সেখানে অন্তত দু’মিনিট গুজবে কান না-দেওয়ার কথা বলবেন— এমনই সিদ্ধান্ত হয়েছে।’’ বলাগড়েও গ্রামে-গ্রামে সচেতনতা শিবির আয়োজনে উদ্যোগী হয়েছে তৃণমূল।
এর পাশাপাশি, ভবঘুরেরা যাতে গুজবের শিকার না হন, সে জন্য তাঁদের হোম বা বাড়িতে ফেরানো হচ্ছে। শুধু নদিয়ার চাপড়া থানা এলাকাতেই গত চার দিনে ১২ জন মানসিক ভারসাম্যহীন এবং ভবঘুরেকে উদ্ধার করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশের হাতে যে ২৫ জন ধরা পড়েছে, তারা গুজব–পরবর্তী মারধর বা হিংসার ঘটনায় অভিযুক্ত। তাদের জেরা করে পুলিশ জানার চেষ্টা করছে, কারা গুজব ছড়িয়েছিল।
যে সব জেলায় এখনও পর্যন্ত গুজব সংক্রান্ত হামলার খবর নেই, সেখানেও সব থানাকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পুলিশের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারিও। সন্দেহজনক নম্বর ট্র্যাক করা হচ্ছে।’’
ডিজি-র কথায়, ‘‘আমরা নজর রাখছি। গুজব ছড়ানোটা অপরাধ। গুজবে কান দেবেন না।’’ যা শুনে রাজ্যের বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তীর কটাক্ষ, ‘‘ওই আবেদনেই স্পষ্ট, রাজ্যের পুলিশ এবং গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কাজ করছে না। তাই ঘটনা ঘটার পরে ‘গুজবে কান দেবেন না’ বলতে হচ্ছে।’’