প্রতীকী ছবি।
ডাক্তারবাবু কোনও বিশেষ সংস্থার পেসমেকার বা অর্থোপেডিক ইমপ্ল্যান্ট তাঁর প্রেসক্রিপশনে লেখেন। বিনিময়ে ওই সংস্থা প্রতি মাসে দামি উপহার, বিদেশ ভ্রমণের খরচ অথবা নগদ টাকা পৌঁছে দেয় তাঁর কাছে। বছর শেষে ওই খরচকে সংস্থা আয়কর দফতরের কাছে নিজেদের ‘বিজনেস এক্সপেন্ডিচর’ অথবা ‘অ্যাডভার্টাইজমেন্ট এক্সপেন্স’ হিসেবে দেখায়!
কোনও এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত রোগী ‘রেফার’ করেন এক ডাক্তারবাবু। বদলে মোটা টাকার ‘রেফারাল ফি’-র চেক এসে যায় হাসপাতালের তরফে। সেই ‘ফি’-কে হাসপাতাল নিজেদের খরচ হিসেবে আয়কর দফতরের কাছে পেশ করে। একই ভাবে রোগী রেফারের পুরস্কার হিসেবে বহু ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ল্যাবরেটরি নিয়মিত ‘রেফারাল ফি’ দেয় বহু চিকিৎসককে। সেটিও সংস্থার খরচ হিসেবে দেখানো হয়।
দিন কয়েক আগে সংসদে পেশ করা পারফরম্যান্স অডিটের ২৭ নম্বর রিপোর্টে এই চালু রীতির কথা উল্লেখ করে একে সম্পূর্ণ ‘অবৈধ’ বলে ব্যাখ্যা করেছে কন্ট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি)। তারা জানিয়েছে, সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডিরেক্ট ট্যাক্সেস (সিবিডিটি)-এর নির্দেশিকা এবং ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল কাউন্সিল আইন মোতাবেক এই ধরনের ‘রেফারাল ফি’ দেওয়াই যায় না। ফলে একে নিজেদের ‘ব্যয়’ হিসেবে দেখিয়ে কোনও সংস্থা বা হাসপাতাল কর ফাঁকি দিতে পারে না।
রাজস্ব মন্ত্রক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রকের একাধিক কর্তাই জানাচ্ছেন, এত দিন এই কমিশনের ‘খেলা’ অভিযোগের স্তরে ছিল। বাস্তবে তা কতটা বিপজ্জনক ভাবে ছড়িয়েছে এবং শুধু রেফারাল ফি-র লোভে অকারণে কত রোগীকে পরীক্ষা ও ভর্তি হওয়ার জন্য রেফার করা হচ্ছে, সেটা সিএজি-র রিপোর্টেই প্রমাণিত। কলকাতারএক নামী প্লাস্টিক সার্জনের কথায়, ‘‘রোগী পাঠালে চেক পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে আমাদের কাছে তো ক্রমাগত এসএমএস বা ফোন আসে।’’
সিএজি-র রিপোর্টে ‘রেফারাল ফি’-র মাধ্যমে কর ছাড়ের যে তিনটি উদাহরণ রয়েছে, তার মধ্যে দু’টিই কলকাতার। একটিতে কলকাতার এক সার্জিক্যাল ও মেডিক্যাল যন্ত্রপাতি সরবরাহকারী সংস্থার কথা বলা হয়েছে। তারা ২০১২-’১৩ সালে এক কোটি টাকা ও ২০১৩-’১৪ সালে দু’কোটি ৩২ লক্ষ টাকা চিকিৎসকদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়া ও উপহার দেওয়ায় ব্যয় করেছে। সেটি ‘বিজনেস প্রোমোশন এক্সপেন্ডিচর’ হিসেবে দেখিয়েছে তারা। সিএজি-র কথায়, এটা আয়কর অফিসারদের মানার কথা নয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তারা ২০১০-’১১ সালে প্রায় ৪৮ লক্ষ টাকা, ২০১১-’১২ সালে প্রায় ৫২ লক্ষ টাকা এবং ২০১২-’১৩ সালে প্রায় ৬৪ লক্ষ টাকা ‘রেফারাল ফি’ দিয়েছে। তাকে হাসপাতালের ব্যয় হিসেবে দেখানো হয়েছে। ওই হাসপাতালের মুখপাত্র সুদীপ্ত মিত্র বলেন, ‘‘আমরা কোনও চিকিৎসককে এই টাকা দিই না। গোটা রাজ্যে এবং ভিন্ রাজ্যে আমাদের কিছু ফ্র্যাঞ্চাইজি সেন্টার আছে, যারা কমিশনের বিনিময়ে আমাদের রোগী জোগাড় করে দেয়। এটাকে যদি বেআইনি বলা হয়, তা হলে আবার নতুন করে ভাবতে হবে।’’ এই দু’টি ক্ষেত্রেই আয়কর বিভাগের জবাব চাওয়া হয়েছে।
সিএজি-র ডিরেক্টর জেনারেল (ডিরেক্ট ট্যাক্সেস) গোবিন্দ ভট্টাচার্যের কথায়, ‘‘সিবিডিটি-র দেওয়া উত্তরে আমরা সন্তুষ্ট নই। আমরা রিপোর্টে সমস্ত জানিয়ে সংসদে পেশ করেছি। সেখানে পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি বিষয়টি দেখবে এবং তারা মনে করলে অ্যাকশন টেকেন নোট পাঠাবে।’’
রিপোর্টে আরও রয়েছে, নিজেদের চ্যারিটেবল হাসপাতাল বলে দাবি করে বহু হাসপাতাল ভিতরে ভিতরে মুনাফা করছে। উল্লেখযোগ্য ভাবে, এ ক্ষেত্রেও কলকাতার একটি স্নায়ু রোগ কেন্দ্রের উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।