পুলিশ ও সেচ দফতরের অভিযান

রাস্তা পাল্টেও পার পেল না বালির গাড়ি

সবে সন্ধে নেমেছে। লাঠি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দল পুলিশ। লরি বা ট্রাক্টর দেখলেই আটকে দিচ্ছে তারা। আর সঙ্গে সঙ্গে বড় টর্চ নিয়ে ছুটে আসছে কয়েক জন। চালকের কাছ থেকে নথিপত্র চেয়ে দেখে চিৎকার করে তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘‘স্যার, ওভারলোড আছে।’’ এর পরেই এত ক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেচ দফতরের আধিকারিকেরা গিয়ে লরি আটক করে জরিমানা করার নির্দেশ দিচ্ছেন।

Advertisement

সৌমেন দত্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৭ জুলাই ২০১৫ ০১:৫২
Share:

আঝাপুরে ধরা হল ট্রাক্টর। পালশিটে লরি আটকে কাগজপত্র পরীক্ষা। রবিবার রাতে। ছবি: উদিত সিংহ।

সবে সন্ধে নেমেছে। লাঠি হাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে এক দল পুলিশ। লরি বা ট্রাক্টর দেখলেই আটকে দিচ্ছে তারা। আর সঙ্গে সঙ্গে বড় টর্চ নিয়ে ছুটে আসছে কয়েক জন। চালকের কাছ থেকে নথিপত্র চেয়ে দেখে চিৎকার করে তাঁরা জানাচ্ছেন, ‘‘স্যার, ওভারলোড আছে।’’ এর পরেই এত ক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেচ দফতরের আধিকারিকেরা গিয়ে লরি আটক করে জরিমানা করার নির্দেশ দিচ্ছেন।
দৃশ্য দুই। জামালপুরের আঝাপুর মোড়। এক দিকে জামালপুর, অন্য দিকে মেমারি। মাথার উপরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উড়ালপুল। নীচে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটি বালি বোঝাই গাড়ি। সন্ধে পৌনে ৮টা নাগাদ সেচ দফতরের গাড়ি এসে দাঁড়াল। আগে থেকেই পুলিশকর্মীরা দাঁড়িয়েছিলেন। আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। কিন্তু, একটি ট্রাক্টর ছাড়া ফাঁদে পড়ল না কিছুই। সেচ দফতরের অফিসারকে কর্মী ও পুলিশরা বললেন, “কয়েক দিন আগে এখানেই সেচমন্ত্রী বেআইনি বালির গাড়ি আটকেছিলেন। তার পর থেকে এ দিকে বালির গাড়ি যাওয়া কমে গিয়েছে।” শোনার পরেই ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে কথা বলে কৌশল পাল্টালেন সেচ-কর্তা।
দৃশ্য তিন। গভীর রাত। মেমারি কলেজ মোড়ে চার দিক সুনসান। কৌশল বদলের ফল হাতেনাতে পেল সেচ দফতর। এক্সপ্রেসওয়ে ছেড়ে পুরনো জিটি রোড ধরে কলকাতার দিকে যাওয়া বালির গাড়ি পরপর ধরা পড়ছিল দফতরের কর্মীদের হাতে। কারও কাছে ভুয়ো চালান, কোনও লরিতে আবার ওভারলোড। জরিমানা দিয়ে অনেকে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন। যাঁরা জরিমানা দিতে পারলেন না, তাঁদের গাড়ি আটক করা হল।

Advertisement

রবিবার সন্ধে থেকে সারা রাত এ ভাবে বেআইনি বালির গাড়ি ধরতে যৌথ ভাবে অভিযান চালাল পুলিশ ও সেচ দফতর। সেচ দফতর সূত্রে জানা যায়, গত এক মাস ধরেই রাতের অন্ধকারে কখনও যৌথ ভাবে, কখনও আবার শুধু পুলিশ বালির গাড়ি ধরতে অভিযান চালিয়েছে। সোমবার সকালে সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “রবিবার রাতভর অভিযান চালিয়ে ৮ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। ৭০টি বালির গাড়ির মধ্যে ২৫টি গাড়ি আটক হয়েছে। জরিমানার টাকা পেলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে।” কয়েক দিন আগে পুলিশ পরপর দু’দিন অভিযান চালিয়ে ৪৫৩ ও ২৬৮টি গাড়ির কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছিল। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, এখনও পর্যন্ত পুলিশ প্রায় ১৪০০টি বেআইনি বালির গাড়ি থেকে আনুমানিক ৭৫ লক্ষ টাকারও বেশি জরিমানা আদায় করে সেচ দফতরের হাতে তুলে দিয়েছে। গত কয়েক দিনে সেচ দফতরও ৫০ লক্ষ টাকা জরিমানা আদায় করেছে।

বারবার অভিযান করেও বর্ষাকালে যে বেআইনি বালি খাদান বন্ধ করা যায়নি, তা বেশ বুঝতে পারছেন সেচ-কর্তারা। এ দিন মেমারিতে যে গাড়িগুলি ধরা পড়ে, সবার গন্তব্যস্থল ছিল বারাসাত কিংবা বসিরহাট। তাঁরা সেখানকার সিন্ডিকেটের কাছে বালি বিক্রি করতেন বলে জানা গিয়েছে। দামোদরের যে সব প্রান্ত থেকে বালি নিয়ে গাড়িগুলি আসছিল, সেই সব জায়গায় ভূমি দফতর কিংবা সেচ দফতর অনুমোদিত কোনও খাদানই নেই। সেচ দফতরের অন্যতম রেভিনিউ অফিসার অমিতাভ চৌধুরী বলেন, “আমাদের কাছে ভূমি দফতরের একটি তালিকা রয়েছে। সেই তালিকা অনুযায়ী চালানের সই সংশ্লিষ্ট অফিসারের কি না খতিয়ে দেখে তবেই গাড়ি ছাড়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সই জাল করা হয়েছে।” এমনকী, সেচ দফতরের দেওয়া চালানের ‘বারকোড’ও জাল করা হয়েছে। ওই সব চালানে ‘সিকিউরিটি কোড’ থাকায় তা খুব দ্রুত ধরা পড়ে যাচ্ছে।

Advertisement

এ দিন সেচ দফতরের কর্তারা বেআইনি বালির গাড়ি ধরার জন্য বারবার পরিকল্পনা পাল্টেছেন। জামালপুরের আঝাপুর থেকে চৌবেড়িয়া হয়ে দাদপুর ঘাট। সেখান থেকে আবার মেমারির নদীপুরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন সেচ-কর্তারা। অন্য দিকে, পালসিটে তল্লাশি চলছে জানার পরে বালির গাড়ি শক্তিপুরে দাঁড়িয়ে পড়েছে। সেখানেও হানা দিয়ে গাড়ির নথিপত্র খতিয়ে দেখেন কর্তারা। দামোদর ক্যানাল ডিভিশনের রেভিনিউ অফিসার মনসিজ গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “দক্ষিণ দামোদর ও জামালপুর থেকে বালি ভর্তি গাড়ি যে সব রাস্তা দিয়ে কলকাতা যায়, সেই সব রাস্তার মোড়ে আমরা অভিযান চালিয়েছি।” বর্ধমান সেচ দফতরের মতো হুগলির চাঁপাডাঙাতেও রাতভর অভিযান করে সেচ দফতর।

সেচ দফতরের হিসেবে, দিনে গড়ে এক হাজার বালির গাড়ি দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কলকাতা যায়। সেচ দফতরের কর্তাদের দাবি, মাসখানেক ধরে টানা তল্লাশি চালানোর ফলে প্রকৃত খাদান মালিকের কাছ থেকে বালি কেনার প্রবণতা বেড়েছে। তবে ওভারলোডিং-এর সমস্যা রয়েছে প্রচুর। তাঁদের আশা, টানা অভিযান চললে এই প্রবণতাও কেটে যাবে। সরকারের রাজস্ব আদায়ও বাড়বে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন